ডিম-মুরগি আমদানির চিন্তা

news paper

সাজেদা হক

প্রকাশিত: ২০-২-২০২৩ দুপুর ৪:১৮

15Views

ডিম-মুরগির বাজারে অস্থিরতা থামছেই না। ইতোমধ্যে ব্রয়লার মুরগির কেজি ডাবল সেঞ্চুরী অর্থাৎ দুইশ ৪০ টাকা অতিক্রম করেছে। দেড় মাসে দাম বেড়েছে ১০০ টাকারও বেশি। এদিকে ব্রয়লার মুরগি আর ফার্মের ডিমের বাজার অস্থিতিশীলতার জন্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ি করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের উদাসীনতায় কর্পোরেট পোল্ট্রি প্রতিষ্ঠানগুলো সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার থেকে প্রায় ২২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রান্তিক খামারিরা। শবেবরাত ও রোজাকে সামনে রেখে ডিম-মুরগির দাম আরো বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে বলেও জানিয়েছে ছোট খামারিরা।

আর খামারিদের এই দুর্দশা থেকে বাঁচাতে ডিম-মুরগি আমদানির পরিকল্পনা করছে সরকার বলে জানিয়েছে একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র। নাম না প্রকাশ করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, ডিম ও মুরগির দাম ২/১ দিনের মধ্যে না কমলে আমদানির উদ্যোগ নেবে মন্ত্রণালয়। 

সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ আমিষের চাহিদা মেটাতে নির্ভর করে ব্রয়লার মুরগি আর ডিমের ওপর। কিন্তু দফায় দফায় ডিম আর ব্রয়লারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা-ও এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে।  ফেব্রয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহে দাম বাড়তে শুরু করে। সপ্তাহ ব্যবধানে ডিমের ডজন ১৫ থেকে ২০ টাকা, আর মুরগি কেজিতে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

খামারিদের হিসেবে, বাজার কপোর্রেট সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাওয়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার প্রান্তিক পোল্ট্রি ফার্মের মধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে লাখেরও অধিক। সরকারি হিসেবে টিকে আছে ৮৪ হাজার। শুধু কর্পোরেট নয়, প্রান্তিক খামারিদের প্রণোদনা না দিলে বিদেশ থেকে আমদানি করেও মুরগির মাংস ও ডিমের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না বলেও জানান খামারিরা। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরকে আরো তৎপর হবার তাগিদও দেন প্রান্তিক খামারের নেতারা।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে ১ কেজি ব্রয়লার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৪০ টাকা, লাল মুরগি ৪৭০ টাকা দরে। এছাড়া লাল ডিমের দাম ডজন প্রতি-১৪৫ টাকা, সাদা ডিমের ডজন-১৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সুমন হাওলাদার বলেন, এখন তো ভোক্তারা ব্রয়লার মুরগি ২২০-২৪০ টাকা কেজি ধরে খাচ্ছেন। বাজার মনিটরিং না হলে-আগামীতে এ মুরগি ৩০০ টাকা কেজি ছাড়িয়ে যাবে। যদি আমাদের খামারি ভাইদেরকে টিকিয়ে না রাখা যায়। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে বৃহত্তর পোল্ট্রি শিল্প জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই, ডিম-মুরগি ও টোটাল পোল্ট্রি বাজারকে তারা নিয়ন্ত্রণ করবে।

সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, খুচরা বাজারে দাম বেড়ে প্রতিহালি ডিম ৫৫-৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এতে গত এক মাসে দাম বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। সংস্থাটির মতে, ব্রয়লার মুরগি ২৪০-২৫০ টাকায় অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ার কারণ পর্যবেক্ষণে ৩টি প্রধান কারণ ধরেন। প্রথমত- স্থানীয়ভাবে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের উৎপাদন কম। ফলে অন্য জেলা থেকে আমদানি করতে গিয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত- পোল্ট্রিজাত খাদ্য ও ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। তৃতীয়ত- সিলেটে একটা মধ্যসত্বভোগী শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা স্থানীয় খামারিদের পাশাপাশি ও অন্যজেলা থেকে আমদানি করা মুরগি মজুত করে থাকে। তাদের মাধ্যমে মুরগি ও ডিম বাজারে যাওয়ায় এর প্রভাব বাজারে পড়ে। ফলে দাম তুলনামূলকভাবে বেশি বাড়ে।  

রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা উম্মে কুলসুমের পরিবারে মাসে ডিম লাগে ২০০টির মতো। কয়েক মাস ধরেই দেশের বাজারে ডিমের দাম বাড়তি। কুলসুমের পরিবারে ডিমের পেছনে খরচ আগের চেয়ে প্রায় ১০০০ টাকা বেড়েছে। তিনি বলেন, ডিমের বাড়তি দামে সংসারে চাপ তৈরি হয়েছে।

কুলসুমের মতো অনেক পরিবারের ওপরই ডিমের বাড়তি দামের প্রভাব পড়েছে। অনেকে ডিম খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন, আবার অনেকে খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। দেশের বাজারের ডিমসংকট ও বাড়তি দামের পরিপ্রেক্ষিতে ১০টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ১৫১ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি চেয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে শুল্ক ছাড়ে আনতে পারলে ছয় টাকা পিস ডিম বিক্রি করা যাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে খামারিরা ডিম আমদানিতে আপত্তি জানিয়েছেন।

ভারতের ডিমের ওজন কম বলে দাম কম মনে করেন পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসীন। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় উৎপাদন দিয়েই আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে আসছি। একদিকে যেমন ভোক্তা পর্যায়ে অসন্তোষ আছে, আবার খামারিরাও উৎপাদনমূল্য পাচ্ছে না। এর ফলে খামার সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার ডিম আমদানি করলে তার নেতিবাচক প্রভাব আরও পড়বে। তবে টাইগার ট্রেডিংয়ের কর্ণধার মো. সাইফুর রহমান বলছেন, খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত করে তাঁরা ডিম আমদানি করতে চান না। তবে তিনি এ-ও বলেন, খামারিরা সিন্ডিকেট করে বাড়তি দামে ডিম বিক্রি করলে মেনে নেবেন না। বর্তমানে প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খরচ কত হচ্ছে, তা প্রতিবেদন আকারে সরকারকে জানিয়েছে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)।

দেশে ডিমের বাজার স্থিতিশীল করতে প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র। তারা বলছেন,  যদি আমদানি করলে দাম কমে, তবে ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে ডিম আমদানি করতে গেলে একটু সময় লাগবে। 


আরও পড়ুন