কর্ণফুলী নদীতে কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা

news paper

মো. কামাল উদ্দিন

প্রকাশিত: ২৫-৬-২০২৪ দুপুর ২:৫৪

197Views

কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নে দাবি নিয়ে আমরা দীর্ঘ বছর যাবত বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি ও চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের উদ্যোগে আন্দোলন জোরদার করে আসছি, শুধু আন্দোলন নয়, সেতুর যৌক্তিকতা নিয়ে আমি অসংখ্য লেখা লিখেছি, তারাই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র বরাবরে ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এ-র মাধ্যমে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের পক্ষ থেকে স্মারক লিপি প্রদান করেছি। তবে- এর আগেও কয়েকটি স্মারক লিপি আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রেরন করেছি, আমরা আশা করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবীসমূহ আমলে নিয়ে সেতু বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগ নেবেন। আমি আজ আমার লেখার মাধ্যমে সেতুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চট্টগ্রামের জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর অবস্থিত কালুরঘাট সেতুটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, এটি শহরের জীবনীশক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৩১ সালে নির্মিত এই সেতুটি চট্টগ্রামের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বর্তমানের জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে এটি একটি মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে, যা স্থানীয় জনগণের জীবনে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।
কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে চলাচলকারী এই সেতুটির উপর চাপ এতটাই বেশি যে, বিগত ২০ বছর ধরে এটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলেও চলাচল অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে সেতুটির বিভিন্ন অংশে বড় ধরনের ফাটল ও ক্ষতি দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেতুটির সংস্কার প্রচেষ্টা চললেও তা পর্যাপ্ত নয়। বর্তমান অবস্থা এমন যে, প্রতিনিয়ত সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াতকারী লক্ষ লক্ষ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মধ্যে কক্সবাজার পর্যটন শহরের সাথে রেল সংযোগ চালু হওয়া একটি বড় সাফল্য। তবে এই সাফল্যের সাথে কর্ণফুলী নদীর উপর নতুন সেতু নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে সেতুটির মেরামত কার্যক্রম চালানো হলেও তা শুধুমাত্র অস্থায়ী সমাধান হিসেবে কাজ করছে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি ও দুর্ঘটনার হার ক্রমবর্ধমান।
ফেরি চলাচলও অপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যার ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এর ফলে মানুষের জীবনহানি, অর্থনৈতিক ক্ষতি, এবং পরিবহন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কালুরঘাট সেতুর মেরামত কার্যক্রম

২০০৪ সালে: এই সময়ে সেতুর বড় ধরনের সংস্কার করা হয়, যার ব্যয় ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে: একটি জাহাজের সাথে ধাক্কায় সেতুর একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামত করা হয়। চলমান মেরামত: ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক সংস্কার প্রচেষ্টা, যার ব্যয় ৪৩ কোটি টাকা এবং এটি আট মাসের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা।
সেতু বন্ধের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ঘটনার তালিকা
যাত্রীদের প্রাণহানি:  ফেরি চলাচলের সময় একজন কলেজ শিক্ষার্থীর প্রাণহানি সহ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি: সেতু বন্ধ থাকার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। পরিবহন সমস্যা: বিকল্প পথে যানবাহন চলাচলের জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে, যা অগণিত যাত্রীদের যাতায়াতে অসুবিধা তৈরি করেছে।প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি: ফেরি পরিচালনা এবং সেতু মেরামতের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে।
প্রস্তাবনা ও সমাধান
চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম থেকে আমরা প্রস্তাব করছি, কালুরঘাটে নতুন দ্বিমুখী সড়ক-রেল সেতুর নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সেতুর নকশা করে তা স্থায়িত্বশীল এবং দীর্ঘমেয়াদী করার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এছাড়া সেতুর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।
নতুন সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি পূরণের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করাও প্রয়োজন। সেতুর নকশা ও নির্মাণকাজে স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও এই প্রক্রিয়াকে সফল করতে সহায়ক হবে।
নাগরিক ফোরামের প্রস্তাবনা সমূহ
নতুন সেতুর নির্মাণ দ্রুত শুরু করা:  জরাজীর্ণ সেতুর পরিবর্তে নতুন দ্বিমুখী সড়ক-রেল সেতুর নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা অতীব প্রয়োজন। সেতুর নকশায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার:  নতুন সেতুর নকশায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা স্থায়িত্বশীল এবং দীর্ঘমেয়াদী করা যেতে পারে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা: নতুন সেতুর নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।অর্থনৈতিক সহায়তা: সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি পূরণের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান।স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ: সেতুর নকশা এবং নির্মাণকাজে স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

পরিকল্পিত ও দৈনন্দিন চাহিদামতো ফেরি চলাচল: নতুন সেতু নির্মাণকাজ চলাকালে পরিকল্পিত ভাবে ফেরি চলাচল পরিচালনা করা, যাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো যায়।বিকল্প সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা: 
সেতুর নির্মাণকাজ চলাকালে যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমানো যায়। পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ: সেতুর নির্মাণ প্রকল্পে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা, নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন ইস্যু ও সমস্যা চিহ্নিত করে উপস্থাপন করে আসছি এবং এই সাথে আপনার সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমও তুলে ধরছি। উল্লেখ্য যে, আশির দশকের শেষ দিক থেকে বিগত সরকারগুলির আমলেও আমরা বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির গঠন করে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য জলাবদ্ধতা নিরসন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন সম্প্রসারণ, বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, যানজট নিরসন, চট্টগ্রামে পৃথক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রামে শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উন্নয়ন, লিংক রোড ও নদী-সমুদ্রের তীরে বাঁধ নির্মাণসহ ১৫ দফা দাবি বাস্তবায়নে অনেক সংগ্রাম করেছি; বিশেষ করে এরশাদ আমলে পাঁচশতাধিক সংগঠনের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ৪৮ ঘন্টাসহ কয়েকটি সফল হরতাল ও অবরোধ পালন করে চট্টগ্রামের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের প্রতিবাদ করেছিলাম এবং আমাদের অনেক দাবি ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সেই জনপ্রিয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের রূপকার, তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে দেশে বিদেশে সুপরিচিত সফল আইনজীবী, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠক ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম ২০১৫ ইং সালে গঠিত হয়। এটি একটি সামাজিক ও চট্টগ্রামবাসীর অধিকার আদায়ের সংগঠন হলেও আমাদের আদর্শ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সোনার মানুষের পক্ষে কথা বলা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে কাজ করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, তাতে আমরা আশাবাদী যে, কর্ণফুলী নদীর উপর নতুন সেতু নির্মাণও অচিরেই বাস্তবায়িত হবে। এই সেতু নির্মাণ চট্টগ্রামের জনগণের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে এবং শহরের উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
আসুন আমরা সকলে মিলে এই দাবির পক্ষে সোচ্চার হই এবং চট্টগ্রামের জনগণের জন্য একটি নিরাপদ ও উন্নত সেতু নির্মাণে সহায়তা করি। আমাদের বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম। 


আরও পড়ুন