পদ্মারচরে রাসেল'স ভাইপার, কিভাবে এলো মানিকগঞ্জে?
প্রকাশিত: ৫-৬-২০২৪ দুপুর ২:৫৭
রাসেল'স ভাইপার সাপ, বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে রাসেল'স ভাইপার বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ। এর আগে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বেশ কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে পদ্মাতীরবর্তী কয়েকটি জেলা ও চরাঞ্চলে এই বিষধর রাসেল'স ভাইপারের কামড়ে মৃত্যুর কারণে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চলে এই সাপের কামড়ে বেশ কয়েকজনের প্রানহানির ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।সত্যতা যাচাইয়ে সরেজমিনে, আমি এবং যমুনা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার বিএম খোরশেদ ভাই হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চলে। পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে উপজেলার আজিমনগর,সুতালড়ি ও লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এখানে তাদের প্রধান জীবিকা নির্বাহের কাজে কৃষিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
স্থানীয়দের মতে- গত কয়েক বছর আগে উজানে থেকে বয়ে আসা বন্যার সময় কচুরিপানা বা খড়কুটোর উপর ভেসে এই সাপ নদী তীরবর্তী এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণি বিদ্যাবিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বিবিসি বাংলার বরাত দিয়ে জানান, পদ্মার অববাহিকা ধরেই রাসেল'স ভাইপার মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলে গেছে। ২০১৩ সাল থেকে এই সাপটি বেশি দেখা যাচ্ছে। পদ্মার চরাঞ্চল থেকে শাখা ও উপনদী ধরে কচুরিপানার সাথে এগুলো পাশের এলাকাগুলোতে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জের চরে সেভাবেই গেছে বলে মনে হচ্ছে, " বলছিলেন তিনি।
২০১৩-১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২০ টি রাসেল'স ভাইপারের দংশন বিশ্লেষন করা একটি গবেষণার ফল জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ। এছারাও, ২০১৪-১৫ সালে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি চর এলাকায় বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা অন্তত ৫টি রাসেলস ভাইপার অবমুক্ত করা হয়। গবেষনায় উঠে আসে যে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৭ টি জেলাতেই রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি রয়েছে। সুত্র-বিবিসি বাংলা।
পদ্মানদীর চরাঞ্চলে জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষি কাজকেই বেছে নিয়েছেন বেশিরভাগ মানুষ। কৃষি জমিতে থাকা প্রাণী ইদুর, ব্যাং এদের প্রধান খাদ্য বলে কৃষি জমিতেই এই রাসেল'স ভাইপারের সংখ্যা বেশি বলে স্থানীয়দের ধারণা।
সরেজমিনে, হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চল লেছড়াগঞ্জ ইউপি পার হয়ে আজিমনগর ইউপির এনায়েতপুর বাজারের পাশে বাসুদেবপুর গ্রামে সামনে এগোতেই চলতি রাস্তার পাশে চোখে পড়লো বেশ কিছু মানুষের সমাগম। দেখা গেলো -সেই বিষাক্ত রাসেল'স ভাইপারের। রাসেল'স ভাইপারের আক্রমন ঠেকাতে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সাপ মারছেন কয়েকজন কৃষক।
এ যেন আমাদের নতুন অজানাকে জানা এবং আতঙ্কের জন্ম দিলো।কৃষকসহ স্থানীয়রা বেশ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।কিছুদিন আগে ভুট্টা ক্ষেতে পানি দেয়ার সময় রাসেল'স ভাইপারের কামড়ে প্রাণ হারান বিদেশ ফেরত কৃষক লালমিয়া।কথা হয় শোকে কাতর লালমিয়ার পিতা শেখ ইদ্রিসের সাথে। তিনি জানান, বিদেশ ফেরত ছেলে জমিতে ভুট্টা ক্ষেতে পানি দেয়ার সময় রাসেল'স ভাইপারের কামরে ৭ দিন ভয়ংকর যন্ত্রনায় মারা যান তার ছেলে। দুই সন্তান এক স্ত্রী রেখে চলে গেছেন লাল মিয়া। এখন মাসুম বাচ্চাদের বুকে আগলে রেখে শোকে দিন কাটাচ্ছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, রাসেল'স ভাইপার সাপ মারা এক যুবক জানান, সাপ মারা অপরাধ, এটা জেনেও আমাদের প্রাণের ভয়ে মেরেছি। আমাদের জীবন হুমকির মুখে। সরকারের কাছে দাবি, আমাদের দিকে একটু নজর দিক, আমরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। গত তিন মাসে প্রায় ২০/২২ টি সাপ মেরেছে চরের মানুষ।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি লেছড়াগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, রাসেল'স ভাইপারের কামড়ে অনেক লোক মারা যাচ্ছে। আপনারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে স্থানীয় সংসদ সদস্য দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু (এমপি) মহোদয় এবং সরকারের কাছে দাবি- একটি জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতাল,সাপে কাটার ঔষুধ এবং এই সাপের হাত থেকে রক্ষা পেতে যা করণীয়, তার দিকে সদয় দৃষ্টি দেবেন। আপনারা সাংবাদিক ভাই আমাদের চরাঞ্চলের দিকে একটু সদয় নজর দেন।
মানিকগঞ্জ ২ আসনের সংসদ সদস্য দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু জানান, রাসেল'স ভাইপার এটা সিরিয়াস একটা ইস্যু। ধন্যবাদ আপনাকে, মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। আজকে সংসদ বসবে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের সাথে কথা বলে সংসদে উপস্থাপন করবো। সেইসাথে এন্টিভেনাম,কৃষকদের জন্য গামবুট, হাসপাতালসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে খুব দ্রুতই।
এই সাপের কামড়ে ভয়ংকর পরিণতির কথা জানালেন হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মেহেরুবা পান্না। তিনি বলেন, এই রাসেল'স ভাইপার বিষধর। এন্টিভেনাম আমাদের এখানে নেই। সাপের কামড়ে এন্টিভেনাম দিলেও মাঝে মাঝে সাইড উফেক্ট হয়ে থাকে। এন্টিভেনামের সাথে প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং জনবল প্রয়োজন। সাপে কাটার পর কিছু সময় এন্টিভেনাম প্রয়োগের পর শ্বাস কষ্টও হতে পারে। তাছারা, সাপে কাটার সাথে সাথে ওঝার কাছে না গিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। আবার সাপে কাটার ১০০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে সঠিক ট্রিটমেন্ট করলে ভাল ফল হবেও বলে জানান।