বহাল তবিয়তে কাস্টমস কর্মকর্তা মহসিন
প্রকাশিত: ১৩-৫-২০২৪ বিকাল ৬:৬
বহাল তবিয়তে কাস্টমসের মহসিন খান। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবর অভিযোগ দায়ের করার পরও কিছুই হচ্ছেনা তার। নিত্য নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে। মহসিন বিভিন্ন মানুষের কাছে বলে বেড়াচ্ছেন তার হাত অনেক শক্তিশালী। সাংবাদিকদের নাকি তার ক্ষমতা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। পত্রিকায় নিউজ করে তার কিছুই নাকি করা যাবেনা।
অফিসের টেলিফোনে যোগাযোগ করে মন্তব্য জানতে চাইলে উল্টো প্রতিবেদককে মামলার হুমকি প্রদান করেন। মহসিন বলেন আপনারা যত পারেন নিউজ করেন আগামী বৃহস্পতিবার আপনাদের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করবো। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আমার কয়েক ডজন বন্ধু বান্ধব আছে কিছুই করতে পারবেননা বলে ফোন কেটে দেন। এলাকাবাসির অভিযোগ যে মানুষটির পরিবারে এক সময় ঠিকমতো তিন বেলা পাতে খাবার জুটাতে হিমশিম খেতে হত, সেই অবস্থা মাত্র দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পাল্টেছে অবিশ্বাস্য যাদুর মত। কিছু কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীদের কারনে রুগ্ন হয় সরকারি কোষাগার আর মোটা হয় ব্যক্তিগত চেহারা। তাদেরই একজন কাষ্টমসের মহসিন খান। সে চলনে বলনে রাজা বাদশা।
তার রাজপ্রাসাদের মত আলিশান বাড়ি দেখতে আসেন আশেপাশের লোকজন। বিদেশি স্টাইলে চারিপাশে প্রাচীর করা পুকুর লাগোয়া তার তিন তলা বিশিষ্ট বাড়ীসহ মহসিন খান অন্তত ৫ কোটি টাকার সম্পদ কিনে ফেলে রেখেছেন নিজ গ্রামে। কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন বাড়ি তৈরিতে অথচ সরেজমিনে গিয়ে বাড়িতে একজন মানুষকেও পাওয়া গেলোনা। তবে কথা হয় মহসিন খানের ছোট কালের বন্ধু সেলিমের সাথে, একসাথে এসএসসি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন তারা। তিনি জানালেন মহসিন ছোট বেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র। এক সময় অর্থের অভাবে লেখা পড়া চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব ছিল। নিজ ভাইয়েরা ছিলেন তার লেখা পড়ার বিরুদ্ধে কারণ তারা মাঠে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করবে আর সে স্কুলে গিয়ে আরাম করবে সেটা তাদের পছন্দ ছিলো না। বাবাও ছিলেন সেই কাতারে। যেখানে কোনমতে বেঁচে থাকা দায় সেখানে লেখা পড়া তো অনেকদুরের কথা। কঠিন সময় যাচ্ছিল তার ঠিক সেই সময় পাশে দেবদূত হয়ে দাড়ালেন সুবল মেম্বার। বললেন চিন্তা করোনা এখন থেকে লেখা পড়ার যত খরচ সব আমি দেব।
তিনি সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করলেন মহসিনকে তার খরচে ভালো মার্কস নিয়ে এসএসসি পাশও করলেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তিনি বর্তমানে কাষ্টমস ভ্যাট ও শুল্ক গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত। বাবা দুনিয়া ত্যাগ করেছেন বেশ কয়েক বছর গর্ভ ধারিণী মা এখনো জীবিত। তার সহদরেরা মাঝে মাঝে ভ্যান চালায় ও মানুষের বাড়িতে এখনো দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করে। একমাত্র বোনকে বিয়ে দিয়েছেন একই গ্রামে। তার বোন জামাইও দিন মজুর বর্তমান অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। এলাকার মানুষের অভিযোগ মহসিন খানের কারণে জমির দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। জমি বিক্রির কথা শুনলেই উচ্চ মূল্য দিয়ে ক্রয় করেন মহসিন খান। তার এতো টাকা কোত্থেকে এলো জানিনা মাঝে মাঝে একেকদিন একেক গাড়ি নিয়ে এলাকায় আসে। তাকে দেখলে মনে হয় সে কাষ্টমসে চাকরি নেওয়ার পর হতে কোন টাকার মেশিন হাতে পেয়েছে। অথচ এই দপ্তরটি সৃষ্টি হয়েছিল দেশের উন্নয়ন ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশ বিভাগের আগে ব্রিটিশ পিরিয়ডে এদেশে কোন কাস্টমস কালেক্টর (বর্তমান কমিশনার) পদ ছিলনা। কোলকাতা কাস্টম হাউসে কালেক্টর পদ থাকতো। কোলকাতা কালেক্টর এর নিয়ন্ত্রনে ছিল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, তখন এদেশের বড় কাস্টম হাউস তথা ঈযরঃঃধমড়হম ঈঁংঃড়স ঐড়ঁংব পদে থাকতেন মাত্র একজন ডেপুটি কালেক্টর তিনিই চালাতেন সমগ্র কাস্টমস কর্মকাণ্ড।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট বৃটিশ থেকে ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়। ভাগ হওয়ার সময় কোলকাতা কাস্টমস কালেক্টর ছিলেন বি সি দে নামক ভদ্রলোক। ইতিহাস থেকে জানা যায় সে সময় ১৮আগস্ট ১৯৪৭ কাস্টম হাউস, চট্রগ্রাম কালেক্টরে পদস্থ হন এ ই রাইট। পাকিস্তান হওয়ার পর ঈযরঃঃধমড়হম ঈঁংঃড়স যড়ঁংব এ কালেক্টর পদে আবারো তাকেই পদস্থ করা হয়েছিলো। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন পরবর্তী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পিও অর্ডার তথা ৭৬/৭২ এ গঠিত হয়েছিলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তার অধীনেই সৃষ্টি হয়েছিলো কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট। ১ জুলাই ৯৫ কালেক্টর পদ পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ হয়েছিলো কমিশনার। জানা যায় প্রথম কমিশনার ছিলেন আজিজুর রহমান এমনকি (শেষ কালেক্টরও ছিলেন তিনি)। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ অতিরিক্ত কালেক্টর থাকাকালীন সময় কালেক্টর এর পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। জানা যায় অবসর পরবর্তী সময়ে তিনি থাকার জন্য একটি ভালো ঘরও তৈরি করতে পারেননি। অথচ তাদের হাত ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা সেই দপ্তরে এখন লক্ষ কোটি টাকা কালেকশন হয়। যা দিয়ে তৈরি হয় পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, বড় বড় অট্টালিকা, ব্রিজ, কালভার্ট, হাইওয়ে রোডসহ আরও কত কিছু। আবার কিছু কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের কারণে বদনামও হচ্ছে দপ্তরটির। এমনি একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবর যার নাম মহসিন খান, পদবী- কাস্টমস সুপারিন্টেন্ডেন্ট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অন্যের খরচে লেখা পড়া করে ১০ বছরের সরকারি জুনিয়র অফিসার মহসিন এখন প্রায় কোটি কোটি টাকার মালিক। নিজ গ্রাম ভবানিপুরে করেছেন আত্মীয় স্বজনসহ নামে বেনামে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। তাঁর মধ্যে নিজের ৩ তলা বিশিষ্ট রাজ প্রাসাদসম বিল্ডিং যার চতুরপাশে প্রাচির করা। সাথে দৃষ্টিনন্দন পুকুর দুই দিকে রাজকীয় সিঁড়িযুক্ত পাকা ঘাটলা।
তাঁর আপন বড় ভাই এখনও ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, সেই বড় ভাইকেও তিনি ৩ তলা ফাউন্ডেশনের ৩/৪ হাজার স্কয়ার ফিট আয়তনের একটি বিল্ডিং নির্মাণ করে দিয়েছেন যার একতলার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। একই গ্রামে বসবাসরত মহসিনের নিজ অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে তাঁর আপন বোনের জন্য ১ তলা বিশিষ্ট একটি নান্দনিক বাড়ি। এলাকাবাসির সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময় অনেক অর্থ কষ্টে দিন কাটতো মহসিনদের। এমনকি ঠিক মতো দুমুঠো ভাতও খেতে পেতোনা তারা সে সময় পাশের বাড়ির সুবল (সাবেক মেম্বার) তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। যাঁর টাকায় মহসিন লিখা পড়া করে আজ এই পর্যায়ে এসেছেন তার নামে দিয়েছেন অর্থ আত্মসাতের মিথ্যা মামলা। সরেজমিন তদন্তে, মহসিনের ভয়ে নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ভবানিপুর গ্রামের একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা হলে তারা তাদের ভাষায় জানান, ‘মহসিনের বাবা মান্নান খাঁ দুধ বিক্রি করে ও চেয়ে চিন্তে কোন রকম দিনাতিপাত করতো এখন তাঁর এক ছাউল কি চাকরি করে জানি না। দেহি হঠাৎ করে ৩ টা বিল্ডিং বানায়া ফালালো।’ অন্য আরেক মহিলার কাছে মহসিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন ‘মান্নান খাঁ অনেকগুলো ছাওয়াল পাল নিয়ে চলতে পারতো না সেই মান্নানের ছাওয়াল না-কি টাহার কুমির।’ এলাকাবাসির এমনও অভিযোগ আছে মহসিন হঠাৎ করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় মানুষের সাথে খারাপ আচরণও করে।
তারই প্রেক্ষিতে গত বছর ৩১ জুলাই মো. শাহ আলম নামের জনৈক ব্যক্তি দুদকে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মূল্য সংযোজন কর, ঢাকার গুলফেশা প্লাজায় কর্মরত কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট তার বর্তমান কর্মস্থল, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট ট্রেনিং একাডেমি সাগরিকা রোড, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম। তিনি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে বিভিন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে ঘুসের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। কম ভ্যাট আদায় দেখিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে তিনি সহায়তা করেছেন। ব্যবসায়ীদের নানা ইস্যু নিয়ে এবং ফাইল আটকিয়ে ঘুস নেন তিনি। তার এসব কাজে সহযোগিতা করেন ওই সার্কেলের কিছু নিম্ন পদস্থ কর্মচারী। মো. মহসিন খানের উপার্জিত সম্পদের আরও সংক্ষিপ্ত বিবরণ। রাজধানীর রামপুরায় অন্তত ২ টি ফ্ল্যাট যার বাজার মূল্য আনুমানিক তিন কোটি টাকা। পূর্বাচলে ৫ কাঠার প্লট যার বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ৫ কোটি টাকা। ৩০ শতাংশ জমি নিজ গ্রামে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার ভবানীপুর রাস্তার পাশে এর ক্রয় মূল্য ৬৫ লক্ষ টাকা। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ওই এলাকার ১৫০ শতাংশ হিন্দু সম্পত্তি মাত্র ৭০ লক্ষ টাকায় জোরপূর্বক ক্রয় করেন, এ জমির প্রকৃত দাম দেড় কোটি টাকা। এছাড়াও ২০২২ সালে ৫২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন দেড় কোটি টাকায়। তার স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে ব্যাংকে ৪ কোটি টাকাসহ নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ রয়েছে তাঁর। ভাগ্নি রিমার ব্যাংক একাউন্টে ১ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা জমা রেখেছেন মহসিন। এলাকাবাসি জানিয়েছেন তার নিজ উপজেলা কালুখালীতে তিনি একটি গুন্ডা বাহিনী পোষেন রাজনৈতিক মাঠ তৈরি করার উদ্দেশ্যে। তাদেরকে তিনি ১৫টি বাজাজ ডিসকভার মোটরবাইকও উপহার দিয়েছেন বলে প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন।
যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো। এখানেই থেমে নেই মহসিনের টাকার গরম তিনি ২৫ জনের একটি দলকে প্লেনে করে কক্সবাজারও ভ্রমন করিয়েছেন। এতে তার ব্যয় হয়েছে অন্তত ১০ লাখ টাকা। ৭০/৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভ্যান চালক আপন দুই ভাইকে দুটি বিল্ডিং এবং নিজে ৪৫ লাখ টাকায় ক্রয়কৃত ২৫ শতাংশ জমির উপর ২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ২ তলা পর্যন্ত করে রেখেছেন। দৈনিক সকালের সময় প্রতিনিধির অনুসন্ধানে তার সম্পদের সঠিক তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের ধারণা সরকারি কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করলে এই নিউজে যে তথ্য এসেছে তার চেয়ে আরো অনক বেশি সম্পদের তথ্য পাবে।