বিএসআরআই প্রাঙ্গণে মনোমুগ্ধকর তাল বাগান

news paper

এম মাহফুজ আলম, পাবনা

প্রকাশিত: ৩-৪-২০২৪ দুপুর ২:৩৭

116Views

জীবন রক্ষাকারী, পুষ্টিকর-সুস্বাদু ও মূল্যবান বৃক্ষ হিসেবে তালগাছের গুরুত্ব স্বীকার করে এখন বৃক্ষরোপণের ওপর  জোর দেয়া হচ্ছে। তালগাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাল গাছ বজ্রপাত নিরোধ হিসেবে কাজ করে। তালপাতা থেকে কাগজ তৈরির বিপুল সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং প্রযুক্তিগতভাবে তালপাতার কাজ শুরু হয়েছে। তাই অতীতের মতো সর্বত্র তালগাছ দেখা যাবে যা সবারই প্রত্যাশা।
সরকারের নির্দেশে কৃষি বিভাগসহ বেসরকারি উদ্যোগে এখন প্রচুর পরিমাণে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে। তাই, কিছুদিন পর আমরা তালগাছের আগের স্মৃতি দেখতে পাব। তালগাছ 'এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’ এই পংতিটি মনে করিয়ে দেবে। তাঁতি পাখিদের  নৈপূন্যে গাঁথা বাসা লম্বা তাল গাছে ঝুলতে দেখা যাবে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন বলেন,‘তালগাছ বজ্রপাত নিরোধ হিসেবে কাজ করে। তাল। গাছে কার্বনের পরিমাণ বেশি থাকায় এগুলো বজ্রপাত প্রতিরোধে সাহায্য করে। কারণ তালগাছেন ছালে কার্বনের পুরু স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা এবং গঠন বজ্রপাত প্রতিরোধে প্রধান ভূমিকা পপালন করে থাকে। 
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে তালগাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন।এই “নির্দেশনায় প্র্রতি বছর কৃষি বিভাগ তাল গাছের চারা সংগ্রহ করে রাস্তার পাশে এবং পতিত জমিতে রোপণ করা হচ্ছে। এছাড়াও স্ব-উদ্যোগে তালগাছ রোপনের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তাল ফল ও তালগাছের বহুমুখীতা ও পুষ্টিগুণের কথা বিবেচনা করে কৃষি কর্মকর্তা দেশীয় ফলের মধ্যে তালের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রতিবছর অন্যান্য গাছ লাগানোর মৌসুমে তালের চারা রোপণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
গত বছর পাবনা জেলার ৯ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ৪ হাজার ১শ’ তালের চারা রোপন করা হয়েছে বলে  কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।  
ঈশ্বরদীতে বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কৃষি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলেন,“প্রায় সব মাটিতেই তালগাছ জন্মে। খেজুরের চারা লাগাতে কোনো খরচ নেই। একটি বীজ বা চারা যেখানেই রোপণ করা হয়; সেখানেই তা গাছে পরিণত হয়। বিশেষ করে মহাসড়ক, গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট, ল্যান্ড ডিভাইডার(জমির আইল), পতিত জমি, রেললাইন, সব খাল, পুকুর পাড়ে তালগাছ লাগানোর উপযুক্ত স্থান।
ঈশ্বরদীতে বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফিজিওলজি ও চিনি রসায়ন বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ কোহিনুর বেগম বলেন,“বাংলাদেশে তাল সাধারণত মিষ্টি রস ও সুস্বাদু গুড়ের জন্য জনপ্রিয়।
তালে পাতা হাতের পাখা, টুপি ও ঘরের ছাউনি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তালগাছের কান্ড অনেক সমাদৃত। ইটের ঘর, টিনের ঘর এবং খড়ের ঘরে তাল গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করা হয়; যা দীর্ঘ দিন টিকশই হয়। তালের রস একটি প্রিয় গ্রীষ্মকালীন পানীয়। গ্রামবাংলায় পাকা তালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তালের পিঠা গ্রাম বাংলায় খুবই জনপ্রিয়। কাঁচা তাল গ্রীষ্মের একটি সুস্বাদু খাবার।
তালের রস থেকে তৈরি গুড় আখের গুড়ের চেয়ে মিষ্টি, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। এতে রয়েছে প্রচুর আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি ও ভিটামিন সি। তালমিছড়ি বেশি জনপ্রিয় যা তাল দিয়ে তৈরি করা হয়। তাই বাংলাদেশে তাল গাছের চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। 
ভবিষ্যতে তালপাতা থেকে কাগজ তৈরির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে এবং সম্প্রতি চট্টগ্রামে তালপাতার প্রযুক্তি চালু হচ্ছে” বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা।
“পিঠা, পাটালি, খির, তালের রসের সাথে পিঠা সুস্বাদু খাবার। কচি তালের নরম খোসা (শাস) সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং সকলের কাছে প্রিয়। বিশেষ করে গ্রাম-বাংলায় অতীতে তাল পিঠা ছাড়া আত্মীয়তার কথা কল্পনাও করা যেত না। 
এছাড়া তালপাতা দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের হাত পাখা তৈরি করা হয়। কাঁচা ঘর, পাকা ঘরের চটি তৈরি করা হয় তালগাছ থেকে। তালগাছ গ্রাম-বাংলার সব পেশার মানুষ নানাভাবে ব্যবহার করে থাকে। 
ওই কর্মকর্তা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, নির্বিচারে তালগাছ কাটার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও  বেড়েছে।” গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য রক্ষা ও সৈৗন্দর্যায়নে তালগাছের বিকল্প নেই। আদিকাল থেকেই তালগাছ বাংলার গ্রামের সৌন্দর্যে ভূমিকা রেখেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে (বজ্রপাত) তালগাছ প্রধান ভূমিকা পালন করে যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
এক সময় বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের পাশে সারি সারি তালগাছ শোভা পেত। কালের পরিক্রমায় তালগাছ প্রায় হারিয়েই গেছে প্রকৃতি থেকে।
তবে এর ব্যতিক্রম দেখা যায় পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়ক সংলগ্ন ঈশ্বরদী বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএসআরআই) বিস্তীর্র্ণ আঙিনায়। বিএসআরআই অফিসের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ পথেই দেখা যায় তালগাছের সুন্দর সারি। এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে আকৃষ্ট হয় পথচারীরা। কেউ এই দৃশ্য ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করেন। অনেকে যানবাহন থামিয়ে ছবি তোলেন।
উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফিজিওলজি অ্যান্ড সুগার কেমিস্ট্রি বিভাগ পলিব্যাগে তালের চারা উৎপাদনের একটি সহজ কৌশল উদ্ভাবন করেছে; যা তালের চারা বেঁচে থাকার ক্ষমতা বাড়িয়েছে।  সেখান থেকে সারাদেশে প্রচুর সংখ্যক চারা সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থা/ প্রতিষ্ঠান  সেখান থেকে চারা সংগ্রহ কওে রোপণ করছে।
ঢাকা সদর দপ্তরের বন কর্মকর্তা মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন,“সরকার তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে তালগাছ লাগানোর ওপর জোর দিয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশে তালের বীজ সংগ্রহ ও রোপণের জন্য মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তা তাল এবং তাল গাছের অনেক গুণাবলী উল্লেখ করেছেন।
ড: কোহিনুর বেগম আরও বলেন, তালে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় তা আমাদেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া তালের শাঁস খেলে লিভারের সমস্যা দূর হয়। এতে প্রচুর আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি এবং বি কমপেক্সø রয়েছে।
এতে উপস্থিত পানি পানের তৃপ্তি বাড়ায় এবং খাবারের স্বাদ বাড়াতে সাহায্য করে। তিনি বলেন, তালশাঁস নামে পরিচিত কচি তালের শাঁস বিভিন্ন খনিজ ও ভিটামিনে ভরপুর। কচি পাম কার্নেলের মিষ্টি স্বাদ শুধু খেতেই সুস্বাদু নয়, পুষ্টিগুণেও ভরপুর।
পাবনা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের ডাঃ কামাল ওসমান ও পাবনা জেনারেল হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কবির মামুন জানান, তালের ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, শরীর ঠান্ডা করা, হাড় মজবুত করাসহ বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে। কঁচি (কচি) তালের রস পানির অভাব দূর করে।


আরও পড়ুন