প্রিয়াংকা রানী রায়
ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের ও কিছু করা উচিত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে
প্রকাশিত: ১৭-৯-২০২৩ দুপুর ৩:৫৪
টংগী গাজীপুরের মেয়ে, নরসিংদীর বৌ প্রিয়াংকা রানী রায়। ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখায় খুব মনোযোগী ছিলেন। রেজাল্টও খুব ভালো ছিলো। ইচ্ছে ছিলো বড় হয়ে ব্যাংকার হবেন। কিন্তু খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষার পর পরই। তাই কোনো কিছুই করা হয়ে উঠেনি। বিয়ের পর ছেলে, মেয়ে হয়ে যায় ২৪ বছর বয়সে।
প্রিয়াংকা রানী রায় তাঁর উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পিছনের গল্প দৈনিক সকালের সময়ের মাধ্যমে জানান- সংসার বাচ্চা সামলিয়েও পড়াশোনা এবং কিছু করার ইচ্ছে বরাবরই ছিলো। কিন্তু কোনো ভাবেই পারিবারিক ভাবে সাপোর্ট পাইনি কখনো কিন্তু কখনো হাল ছাড়ি নি সবসময় শুধু মনে মনে একা একাই চিন্তা করতাম কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। যেই কাজটাই করতাম খুব মনোযোগ সহকারে করতাম এবং সেই কাজগুলোই আমি বেস্ট হতাম ধরেন- রান্না, শ্বশুর বাড়ীতে রান্না করতে করতে একটা সময় মনে হলো আমি রান্না নিয়েই কাজ করবো। তাহলে মনে হয় ভালো কিছু করতে পারবো। চিন্তা আসলে বিজনেস করবো ক্যাটরিং বিজনেস। কিন্তু ক্যাটারিং বিজনেস করতে হলে প্রচুর সময় লাগবে কাটা, বাটা করে খাবার ডেলিভারিতে মোটামুটি দু একজন হেল্পিং হ্যান্ডও লাগবে। কিন্তু আমার পুঁজি নেই, তাহলে কিভাবে দুজন মানুষকে সেলারি দিয়ে বিজনেস কন্টিনিউ করবো। এই আইডিটাও বাদ দিলাম। পরে ভাবলাম সেলাই কাজ শিখলে অর্ডারি কাজ করলেও নিজের একটা আয়ের উৎস হবে। তারপর ২০১৯ এর পুজোর শাড়ী না কিনে আর কিছু টাকা জমিয়ে সেলাই কাজ শিখি। মোটামুটি ভালো ভাবেই সেলাই কাজ শিখে ফেলি এবং অর্ডারি কাজও শুরু করি।
প্রিয়াংকা রানী বলেন, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যখনি মোটামুটি ভালো একটা সেলাই কাজের রেসপন্স পাচ্ছিলাম তখনই করোনা মহামারী শুরু হলো পুরো পৃথিবীর জুড়ে। পৃথিবীটাই ধমকে গেলো আর আমিও খুব ভেঙে পড়েছিলাম। করোনাকালীন সময় সবাই কম বেশি অনলাইন বিজনেস শুরু করে তখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভিন্ন পোস্ট পড়তে পড়তে আমারও মাথায় এলো আমিও অনলাইন বিজনেস করবো বাটিক শাড়ী নিয়ে। কারন শাড়ীর প্রতি আমার বরাবরই একটা দুর্বলতা ছিলো এজন্য খুব বাটিক শাড়ী কেনাকাটা করতাম। করোনার সময় আমিও অনলাইনে শাড়ী অর্ডার করে পরেছিলাম পুজোতে অনলাইন অর্ডার করে। তখন অনলাইন বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আমিও বাটিক শাড়ী নিয়ে কাজ করবো। আর বিভিন্ন পোস্ট পড়তে পড়তে এটা ভালো করে বুঝে গেলাম যে, যে বিষয়ে যার যত বেশি আইডিয়া আছে সেই বিষয়ে কাজ করলে খুব তাড়াতাড়ি সফল হতে পারে। এরপর ২০২১ এর এপ্রিল ১৪, পহেলা বৈশাখ এবং এই পহেলা বৈশাখ কে টার্গেট করে ২০ টা বাটিক শাড়ী অর্ডার করি ঠিক তখনি আমার করেনা পজিটিভ আসে কিন্তু আমার ইচ্ছে শক্তি এতোটাই স্ট্রং যে আমাকে আটকাতে পারেনি।
যখন বিজনেস শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমার হাতে একটা টাকাও নাই। তখন আমার একটা আংটি বিক্রির ৫ হাজার টাকায় সেই টাকা টাকা দিয়ে শাড়ীগুলো আনলাম আর বাকি টাকা বকেয়া ছিলো। অনেক বড় একটা রিস্ক নিলাম। ২০ টা শাড়ীর ছবি পোস্ট করার পরপরই ২ দিনের মধ্যে আমার ১৪ টা শাড়ী অনলাইনে অর্ডার কনফার্ম হয়ে গেলো। শাড়ীগুলো ডেলিভারি দিলাম এবং সেলের টাকা গুলো নিয়ে বকেয়া টাকা শোধ করে এবার আবার ৪০ টা শাড়ী অর্ডার কনফার্ম করলাম। এভাবেই আমার ৫ হাজার টাকার বিজনেস আজকে ৫ লাখ টাকার বিজনেস হয়েছে। এখন আমার স্টকে ৫ থেকে ৭ টাকার পণ্য সবসময় থাকে।
প্রিয়াংকা রানী জানান, আজকে আমার এই সাকসেস এর পিছনের গল্পগুলো কেউ শুনতে আসে না সবাই আসে সফলতার গল্প শুনতে। আমার এই উদ্যোক্তা জীবনের পথচলাটা খুব সহজ ছিলো না কাউকে পাশে পাই নিশ্বশুর বাড়ীর, বাবার বাড়ী এমনকি হাজবেন্ড ও সাপোর্ট করেনি আমার এই পথচলায়। হাজবেন্ড কত শত বার মোবাইল নিয়ে গেছে হাত থেকে, অশান্তির চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি এমনকি আমার সংসারটাই যেনো ভেঙে যাচ্ছিলো এই বিজনেস করার জন্য। তবে হাল ছাড়িনি আমার ইচ্ছে শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস এতোটাই শক্তিশালী ছিলো যে আমি কোনো খারাপ কাজ করছিনা। সৎ পথে থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা যুদ্ধে নেমেছি জিততে আমাকে হবেই। অবশেষে ২০২৩ এ এসে আমার পথচলাটা অনেকটাই সহজ হয়েছে। যখন সবাই আমার রীতিমতো ভালো একটা সেল দেখলো মাসে এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমাকে ইনভাইট দেয়। বেস্ট সেলার হিসেবে মোটামোটি ভালো একটা পজিশনে বিজনেসটাকে দাঁড় করাতে পেরেছি। তখন হাসবেন্ড ও দেখলো এবং মা বোনরাও তখন সাপোর্ট করা শুরু করলো। এখন আমার পরিবারের সংসার খরচের একটা বড় অ্যামাউন্ট কন্টিবিউট করতে পারছি প্রতি মাসে। আমাদের সমাজ বা নিজের কাছের লোক কখনো কেউ উপরে উঠুক বা সফল হোক চায় না। সবাই কিন্তু আপনজন একবার বিপদে পড়ে দেখেন না কে পাশে এসে দাঁড়ায়, কেউ আসবে না। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এজন্য ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের ও কিছু করা উচিত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে।
প্রিয়াংকা রানী রায় এর উদ্যেগের নাম ‘দেশীয় বুটিকস’। তাঁর প্রতিষ্ঠানটিতে সকল প্রকার ব্লক বাটিক, সকল শাড়ী, থ্রি পিস, বেডসিড, গজ কাপর, ডেনিম ব্যাগ,ড্যাফেল ব্যাগ পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির পণ্য যেসমস্ত অঞ্চলে নিয়মিত সরবরাহ করছে তার মধ্যে ঢাকা, টাঙ্গাইল, বরিশাল, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সৈয়দপুর, ফেনী, রাজশাহী অন্যতম। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘রোদেলা বুটিকস’ পণ্য সরবরাহ করছে। বিদেশে যে কয়েকটি দেশে ‘রোদেলা বুটিকস’ পণ্য পাঠিয়েছে সেগুলো - ইন্ডিয়া,কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। প্রিয়াংকা রানী জানান, বড় পরিসরে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বড় করতে ইতোমধ্যেই তিনি ব্যাংক লোনের জন্য আবেদন করেছেন।