ডিমের বাজারে লুটেরা

news paper

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৩-৮-২০২৩ বিকাল ৫:০

137Views

নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের পুষ্টির চাহিদা মেটায় ডিম। তাদের কপাল থেকে সেই ডিমও উঠে যাচ্ছে। কারণ ডিমের বাজারে হানা দিয়েছে লুটেরা। দাম বাড়িয়ে তারা প্রতিদিন ভোক্তার পকেট থেকে লুটে নিচ্ছে ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রতিদিন ভোরে ক্ষুদে বার্তায় দাম নির্ধারণ করে দেন তারা। সারা দেশে সেই দামেই বিক্রি হয় ডিম। দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা সাড়ে চার কোটি। উৎপাদন হয় ৫ কোটির বেশি। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ এখনো ১০ টাকার কম। অথচ সেটা ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ১৫ টাকায়। যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিযান চালাতে শুরু করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তবে দাম কমেনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভোক্তারা। 

জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে মুরগির একটি ডিমের দাম ছিল ১০ টাকা ৫০ পায়সা। এখন তা ১৫ টাকা। দাম বাড়ার কেনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা ব্যবসায়ীদের কাছে নেই। ১৫ দিন আগের দামের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতিদিন সারা দেশের ক্রেতাদের কাছ থেকে সব মিলিয়ে বাড়তি নেওয়া হচ্ছে ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার জানান, বাংলাদেশে প্রতিদিন সব ধরনের ডিমের মোট চাহিদা চার কোটি ৫০ লাখ। উৎপাদন আছে পাঁচ কোটির মতো। তিনি বলেন, দেশে ডিমের উৎপাদন কমেনি। তবে পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। তারপরও খুচরা পর্যায়ে একটি ডিম এখন কোনোভাবেই ১৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। আসলে ডিমের বাজার খামারিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। তারাই ঠিক করে দেয় ডিমের দাম। তিনি জানান, প্রতিদিন সকালে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকজন ডিমের দাম ঠিক করে দেয়। আর সেই দামেই সারা দেশে ডিম বিক্রি হয়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারা তাদের নির্দিষ্ট এজেন্টদের মাধ্যমে সকাল ১০টার মধ্যে মোবাইল ফোনের এসএমসএস, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সরা দেশে ডিমের দাম জানিয়ে দেয়। সেই দামেই বিক্রি হয়। এর সঙ্গে উৎপাদন বা চাহিদার তেমন সম্পর্ক থাকে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, গত বছর একই ভাবে ডিমের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তারপরও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দামে কিছুটা পার্থক্য ছিল। কিন্তু এবার এমনভাবে সিন্ডিকেট করা হয়েছে যে গ্রাম পর্যন্ত খুচরা দাম একই। গত বছরের আগস্টে একইভাবে ডিমের বাজারে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়। তখন ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ও তদন্ত করে কাজী ফার্সসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডিমের বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রমাণ পায়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। ওই পর্যন্তই।

এসএম নাজের হোসেন বলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সেই মামলায় কোনো ফল হয়নি। তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। তাই তারা মজা পেয়ে গেছে। আবারো সিন্ডিকেট করে মুনাফা লুটছে। বাংলাদেশে এখন পোল্ট্রি খামারি আছে ৬০ হাজার। তাদের মধ্যে ২০ হাজার খামারি ডিম উৎপাদন করেন। আর ৪০ হাজার খামারি মুরগি উৎপাদন করেন। এই ৬০ হাজার খামারের মধ্যে ১৯ হাজার খামারিকে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর আওতায় নিয়ে গেছে কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। এটা দাদন ব্যবসার মতো। তাদের আগাম টাকা দিয়ে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেওয়া হয়। সারা বছর সেই একই দামে ডিম ও মুরগি কেনে কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান।

দেশে মোট খামারের তিন ভাগের একভাগ তারা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বাকিরা বিচ্ছিন্ন। তাই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাদের আবার নিজস্ব ফার্মও আছে।সাভারের খামারি দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই সময়ে ডিমের চাহিদা একটু বেশি থাকে। কিন্তু ডিম উৎপাদন কমেনি। পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। আসলে এখন দাম আমাদের হাতে নেই। আর বাজারে যে ডিমের এত দাম তা কিন্তু খামারিরা পায় না। আমাদের একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হয় ১০ টাকার মতো। ৪০-৫০ পয়সা বেশি দামে আমরা বিক্রি করতে পারি। লাভের টাকা চলে যায় কর্পোরেটদের হাতে।

সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, কাজী ফার্মস ও প্যারাগন গ্রুপ এখন ডিমের বাজারে মূল খেলোয়াড়। দেশে পোল্ট্রি শিল্প নিয়ে তিনটি সমিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারাই এগুলো গঠন করেছেন বাজার তাদের দখলে রাখার জন্য। ভোক্তা অধিদপ্তর ছাড়াও গত বছর আগস্টে কাজী ফার্মস, প্যারাগন, সিপি, ডায়মন্ড এগ, পিপলস ফিডসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন। কমিশন ওই মামলার শুনানিতে প্রতিদিন সকালে কাজী ফার্মস যেভাবে ডিমের দাম ঠিক করে দেয় তাতে বিস্ময় প্রকাশ করে।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা গত বছরের আগস্টে ডিমের বাজার অস্থির হওয়ার পর পুরো বিষয়টি তদন্ত করেছি। আমরা দেখেছি বাজারে সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে। আমরা অভিযান চালিয়ে মামলা করেছি। জরিমানা করেছি। আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিযোগিতা কমিশন কাজী ফার্মসহ আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। কিন্তু তারপরও আবার সিন্ডিকেট সক্রিয়। তার কথা, আমরা আবার অভিযান শুরু করেছি। কিন্তু সমস্যা হলো- একটি ডিমের উৎপাদন খরচ কত তা তো আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানা নেই। এটা বলতে পারবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তারা যদি আমাদের জানায় একটি ডিমের উৎপাদন খরচ কত, তাহলে আমরা বাজারে কত বিক্রি হচ্ছে তা দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি। তা না হলে অভিযান চালিয়ে লাভ হয় না বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে কারওয়ান বাজারের অভিযান চালিয়ে এক ব্যবসায়ীকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। ফল হয়েছে - অন্যান্য ডিমের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। তারাও তো কিনে আনে। আমার জানা দরকার উৎপাদন খরচ কত। তাহলে খুচরা বিক্রয়মূল্য কত হওয়া যৌক্তিক তা আমরা বুঝতে পারবো।

সুমন হাওলাদার বলেন, এই ক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটা বড় দায়িত্ব আছে। তারা ডিম, মুরগির উৎপাদন খরচ কত সে ব্যাপারে যদি তথ্য প্রকাশ করে, তাহলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যেতো। আর পোল্ট্রি ফিডের দাম কমিয়েও ডিম ও মুরগির দাম কমানো সম্ভব।
জানা গেছে, এ নিয়ে রোববার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। ডিম সিন্ডিকেটের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, সেই কাজী ফার্মস-এর কোনো বক্তব্য চেষ্টা করেও জানা যায়নি।

খুচরা বিক্রেতারা জানান, ৬ থেকে ৭ দিন ধরে ১০০টি লাল ডিম কিনতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকায। আর প্রতিহালি ডিম ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ডিমের বাড়তি দামের বিষয়ে খামারি ও আড়তদারদের বিরুদ্ধে দোষ চাপান খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, এখন প্রতিহালি ডিমের পাইকারি দাম ৫২ থেকে ৫৩ টাকা হওয়ায় বাধ্য হয়ে খুচরা পর্যায়ে ডিম ৫৫ টাকা হালিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। ডিমের বাড়তি দামের কারণ খুঁজে বের করতে দিনে-রাতে খুচরা-পাইকারি-আড়তে অভিযান চালাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এর অংশ হিসেবে শনিবার সকালে রাজধানীর কাপ্তান বাজারে ডিমের আড়তে অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটি।
 
এ সময় কেনা ও বিক্রি দাম সংরক্ষণ না করে ভোক্তাকে প্রতারিত করার অভিযোগে তিনটি আড়তকে করা হয় জরিমানা। তবে দাম বাড়ার কারণ পেলেও তা গণমাধ্যমে জানায়নি সংস্থাটি।অভিযান শেষে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল গণমাধ্যমকে বলেন, যে যে কারণ ডিমের দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী, সেগুলো স্পষ্ট করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে জানানো হবে। এ মুহূর্তে উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ১১ টাকা। তবে খামার থেকে বাজার পর্যন্ত এই ব্যবসায় জড়িত সবাই যদি যৌক্তিক লাভ করেন, তাহলে ভোক্তা পর্যায়ে একটি ডিমের দাম সর্বোচ্চ কত হতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুসারে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ পড়ে পৌনে ১১ টাকা বা ১১ টাকা। এখন খামারিরা ৫০ পয়সা থেকে ৭৫ পয়সা মুনাফা করতে পারেন। তাহলে ফার্ম গেট থেকে ডিম সাড়ে ১১ টাকায় বিক্রি হয়। ডিমের দাম কোনোভাবেই ১৫ টাকা হওয়ার কথা না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, খামারিদের বুঝতে হবে, কেউ অতিরিক্ত লাভ করে কোনো দিন টিকতে পারে না। ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৩ থেকে সাড়ে ১৩ টাকা হওয়া উচিত।

শামসুল আরেফিন বলেন, নিশ্চয়ই সরবরাহ ব্যবস্থার কোথাও না কোথাও অতিরিক্ত মুনাফা করা হচ্ছে। খামারিদের কত টাকা মুনাফা করা উচিত এই বিষয়টি নিয়ে সরকারের খামারিদের সঙ্গে বসা উচিত। এদিকে বাজার তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্টেও অস্থির হয়ে উঠেছিল ডিমের বাজার। সে সময় ১৮০ টাকা পার হয়েছিল এক ডজন লাল ডিমের দাম।

ফরিদপুরে অভিযান: ফরিদপুরের সদর উপজেলায় ডিমের দামে কারসাজি করায় এক প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জেলা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার বাইপাস এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয় বলে জানান ফরিদপুর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সোহেল শেখ। তিনি বলেন, অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণে ডিমের আড়তে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ডিমের দামে কারসাজি করা, বিক্রয় রসিদে মূল্য না থাকা, মূল্য তালিকা যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করার অপরাধে অ্যাডভান্সড পোল্ট্রি অ্যান্ড ফিস ফিড লিমিটেডকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া হ্যালিপোর্ট বাজারে ডিম, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজার দর তদারকি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। অভিযানে সার্বিক সহযোগিতা করেন জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক মো. বজলুর রসিদ খান ও জেলা পুলিশের একটি দল উপস্থিত ছিলেন।


আরও পড়ুন