জীবন সংগ্রামে মেধাবী শিক্ষার্থী রাব্বি সরকার এখন ঝাল মুড়ি বিক্রেতা

news paper

সাইদুল ইসলাম আবির, রায়গঞ্জ

প্রকাশিত: ১১-৮-২০২৩ দুপুর ৩:১

96Views

শুক্রবার বিকেল ৫ টা। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের জয়ানপুর উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন চার রাস্তা মোড়ে ছোট্ট দোকানে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন রাব্বি সরকার(১৪)।
প্রথমে দেখে দোকানের মালিক অন্য কাওকে  মনে হলেও আসলে ছোট্ট এই শিশু রাব্বি সরকারের এ দোকান। পাশের জয়ানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে পড়ুয়া এই রাব্বি সরকারের ঝালমুড়ি বিক্রেতা হয়ে ওঠার গল্পটি আসলে একটি সংগ্রামের। সমাজের আট দশ জনের মতো মেধাবী শিক্ষার্থী রাব্বি সরকার বড় স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু শুরু থেকে আর্থিক অনটন, বাবা-মায়ের টানাপোড়নের সংসার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর মাত্র  ১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে পড়ালেখাসহ তার পরিবারের আর্থিকসহ সকল পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
একদিকে বাবা হারানো অন্যদিকে পড়ালেখায় আগ্রহ ও পরিবারের প্রতিবন্ধী ছোট্ট বোন ও মায়ের চিন্তা। তখনি শক্ত সাহস আর মনের দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায় মনোযোগ দেন তিনি। ৮ম শ্রেণীতে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীর সংগ্রামের কথা জানায় স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বপ্ন নিয়ে পথ চলা সংগঠনের অন্যতম এডমিন কাজল দাস,তিনি তিনি বলেন রাব্বি সরকারের পিতা আব্দুর রশিদ সরকার এক ছেলে, স্ত্রী ও ১৮ মাস বয়সের একটি প্রতিবন্ধী কণ্যা সন্তান নিয়ে উপজেলার জয়ানপুর এলকায় বসবাস করতেন। শিক্ষার্থী রাব্বি সরকার ৭ম শ্রেণী থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার একমাত্র সংসার চালানোর দোকানটিতে বিকালে বসে বাবার সাথেই ঝাল মুড়ি বিক্রি করতেন। কিন্তু তার বাবা রাব্বি সরকার তার মা ও ছোট বোনকে রেখেই পারি জমান না ফেরার দেশে। অসুস্থ মা আর প্রতিবন্ধী ছোট্টো বোনটার দায়িত্ব এখন এই ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থীর হাতে। সে এখন এই দোকানে ঝালমুড়ি বিক্রি করেই তার সংসার পরিচালনা করছে। এদিকে এই ঝালমুড়ির দোকানে তেমন পুঁজি না থাকায় এক সময় সহযোগিতা করেছিলেন উপজেলার স্বপ্ন নিয়ে পথ চলা সংগঠন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা এস এম বাহাদুর আলী জানায়,গত বছর আমরা জানতে পারি মৃত ওহাব আলী চাচা মালামাল শূন্য বসে থাকেন দোকানে তাই তখন ফেসবুক বন্ধু ও কেআর ফ্যামেলির সার্বিক অর্থায়নে ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতে দোকানের প্রায় সকল মালামাল তুলে দেই। হঠাৎ জানতে পারি সেই ঝাল মুড়ি বিক্রেতা চাচা মারা গেছেন, রেখে গেছেন মেধাবী ছেলে সন্তান এক মেয়ে ও স্ত্রীকে।  সেই সাথে জানতে পারি হঠাৎ চুরি হয়ে যায় তাদের দোকানের সকল মালামাল। সমাজের বৃত্তবান ও উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় মেধাবী শিক্ষার্থী ভালোভাবে লেখা পড়া করে হয়তো জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে বলে মনে করেন এই মানবিক সমাজ কর্মী। 
 
জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে পড়ালেখার পাশাপাশি ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতে হচ্ছে বলে জানান মেধাবী শিক্ষার্থী রাব্বি সরকার। তিনি বলেন, ক্লাস শেষ হওয়ার পর যতটুকু সময় পাই সেই সময়টাতে বিক্রি করি। বেচাকেনা শেষ করে বাসায় যেতে প্রায় রাত ৮টা বেজে যায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে সহজে ঘুম চলে আসে তবে এর মাঝেই স্কুলের সব পড়াশোনা বাড়িতে পড়ে নেই। তিনি জানান,আমি এখন এই দোকানে ঝাল মুড়ি বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছি যা আমাদের সংসারের একমাত্র ভরসা। আমি সহযোগিতা পেলে পড়াশোনা করে একদিন ভালো কিছু করতে  পারবো। মেধাবী শিক্ষার্থী রাব্বি সরকারের বিষয়ে তার বিদ্যালয় জয়ানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ জানান,সে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়ে তার ফলাফল খুবই ভালো।আগে পড়াশোনার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের পাশেই তার বাবার দোকানে বসে ঝাল মুড়ি বিক্রি করতো। এখন তার বাবা মারা যাওয়ার পর সে নিজেই পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার চালাতে বাবার রেখে যাওয়া ঝাল মুড়ির দোকানে বসে ব্যবসা করছেন।পুঁজি না থাকায় সেখানেও নানা সমস্যায় পড়েছে সে। তাই উপজেলা প্রশাসন ও সমাজের বৃত্তবান মানুষেরা যদি তাদের পাশে দাড়ায় তাহলে মেধাবী এই শিক্ষার্থী হয়তো বাকি জীবনে ভালো কিছু করবে বলে জানান তিনি। মেধাবী শিক্ষার্থী রাব্বি সরকারের মা রওশন আরা জানান,আমার এক ছেলে আর কোলে এক ছোট্টো মেয়েকে রেখেই পরপারে চলে গেছে তাদের বাবা আব্দুর রশিদ সরকার। আমি অসুস্থ আমার সংসারের আর্থিক অবস্থা ভালো না।ছোট্ট ছেলে আমার পড়াশোনা করে। সে খুব মেধাবী। পড়াশোনার পাশাপাশি বিকালে তার বাবার রেখে যাওয়া ঝাল মুড়ির দোকানে বসে যা আয় করে তা দিয়েই টেনে চলছে আমাদের সংসার। সরকার ও সমাজের বৃত্তবান মানুষেরা যদি একটু সহযোগিতা করতো তাহলে আমাদের সংসার আর  ছেলেটার পড়াশোনাটা হয়তো চালাতে পারতাম। তার মা রওশন আরা  ছেলের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেই তিনি ঝালমুড়ির দোকান দিয়েছেন। মেধাবী শিক্ষার্থীর সংগ্রামের কথা স্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান মীর ওবায়দুল ইসলাম মাসুম বলেন, রাব্বি একজন মেধাবী শিক্ষার্থী তার ক্লাস রোল ৫। সে তার অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে এক জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছে। আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা ইলিয়াস হোসেন জানান,রাব্বি সরকারের পরিবারে তার মা যদি আবেদন করেন তাহলে সমাজ সেবা অফিসের মাধ্যমে একটি বিধবা ভাতার কার্ড করে দেওয়া হবে ও তার পরিবারে যদি কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি থাকে আর সেটা যদি আবেদন করে তাহলে শতভাগ ভাতা পাওয়ার জন্য সকল সহযোগিতা করা হবে এবং সার্বিকভাবে সমাজসেবা অফিসের আওতায় কোন সুবিধার সুযোগ থাকলে সেটিও তাদের দেওয়া হবে।এ বিষয়ে রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৃপ্তি কণা মন্ডল জানান, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। উপজেলা প্রশাসনের নিকট সহযোগিতার  আবেদন করলে তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।

আরও পড়ুন