কেরু এ্যান্ড কোম্পানির রেকর্ড পরিমাণ মদ বিক্রি : আয়-ব্যায় সমন্বয় করে ৮০ কোটি টাকা লাভ

news paper

জাহাঙ্গীর আলম, দামুড়হুদা

প্রকাশিত: ৫-৮-২০২৩ দুপুর ৪:২৮

316Views

কেরু এ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশে লিমিটেড এর ডিস্টিলারি ইউনিট ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রেকর্ড পরিমাণ মদ বিক্রি করে লাভ করেছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। আয়-ব্যায় সমন্বয় করে ৮০ কোটি টাকা লাভ দেখানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। 
৫৭ লাখ ৭৩ হাজার প্রুফ লিটার মদ বিক্রি করেছে প্রায় ৪৩৯ কোটি টাকায় কেরু এ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের ডিস্টিলারি ইউনিট। রাজস্ব ও লোকসান সমন্বয় করে এ বছর মিলটি মুনাফা অর্জন করেছে ৮০ কোটি টাকার বেশি। যা গত অর্থ বছরের চেয়ে বেশি লাভ হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা । দেশের বাজারে মদের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় কেরুর মদ বিক্রিও হয়েছে কয়েক গুণ বেশি। ডিস্টিলারি বিভাগে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রেকর্ড পরিমাণ মদ উৎপাদন ও বিক্রি করেছে। এ অর্থ বছরে চিনি কারখানা বাদে অন্য সব ইউনিট গুলোতে লাভ করেছে প্রতিষ্টানটি। সেই সাথে ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে কৃষি খামার গুলো। বিগত ৩০ বছরে কৃষি খামারে লোকসান হলেও এবার লাভের মুখ দেখেছে কৃষি খামার। তবে মিলটির ইতিহাসে সর্বনিম্ন মাড়াই হওয়ায় চিনি উৎপাদনও কম হয়েছে। বর্তমানে ডিস্টিলারি ও চিনিকল ইউনিট আধুনিকায়নের কাজ চলছে। কেরু এ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, চলতি অর্থ বছরে ১শ কোটি টাকার মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ১৯৩৮ সালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কেরু এ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড গড়ে উঠে। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন মিলটি পরিচালনা করছেন। কেরু এ্যান্ড কোম্পানির আওতায় রয়েছে চিনি উৎপাদন, ডিস্টিলারি, কৃষি খামার, পরীক্ষামূলক খামার ও জৈব সার কারখানা। চিনি কারখানা বাদে প্রত্যোকটি ইউনিট লাভজনক হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থ বছর। আখ চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব না হলে মিলটির ভবিষ্যাৎ অনিশ্চিয়তার মুখে পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। তবে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন এর সুষ্ঠু পরিকল্পনায় আখ উৎপাদনে নানা মুখি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে । চলতি অর্থ বছর থেকে আখের দাম বৃদ্ধি করে প্রতি মণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২২০ টাকা।
২০২২-২৩ অর্থ বছরে কেরু এ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সর্বনিম্ন ৪২ কার্য দিবস চিনি উৎপাদনের জন্য চালু ছিল। আখ মাড়াই হয় ৪৬৯৩৭ মেট্রিক টন। চিনি উৎপাদন হয় ২৩৮২ মেট্রিক টন। চিনি আহরণের হার ছিল ৫.০৮%। আখের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় মিলটি। এ বছর চিনি বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকার। বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয় ১০০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয় ১০৭ টাকায়। চিনি কলে লোকসান হয় ৬৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৫১ কার্য দিবসে ৫৩ হাজার ৬৯২ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ২৩ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। চিনি আহরণ হয় ৫.৬২ শতাংশ। চিনি কলে লোকসান হয় ৬১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। চিনি উৎপাদনের পর মোলাসেস পাওয়া যায়। ডিস্টিলারি বিভাগের মদ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল মোলাসেস(চিটাগুড়)। মোলাসেস কয়েকটি ধাপে প্রক্রিয়া করে মদ উৎপাদন হয়। বাংলা মদ, বিলেতি মদসহ অন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করা হয়। ৯টি ব্যান্ডের বিলেতি মদ উৎপাদন হয়। ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জারিনা ভদকা, রোসা রাম ও ওল্ড রাম।
২০২২-২৩ অর্থ বছরে ডিস্টিলারি বিভাগ থেকে ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার প্রুফ লিটার মদ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্য ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৬১৯ প্রুফ লিটার বিলেতি মদ ও বাংলা মদ ৩২ লাখ ৮০ হাজার ২২০ প্রুফ লিটার উৎপাদন হয়। এছাড়াও ডিনেচার স্পিরিট, রেক্টিফাইড স্পিরিটসহ অন্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন হয়। দেশের বাজারে বিক্রি হয়েছে ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার প্রুফ লিটার। ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার প্রুফ লিটার মদ বিক্রি করে আয় হয়েছে ৪৩৯ কোটি টাকা প্রায়। সরকারী কোষাগারে রাজস্ব জমা দিয়েছে ১৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ডিস্টিলারির লাভ হয় ১৫২ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ডিস্টিলারি বিভাগ মদ উৎপাদন করে ৫৩ লাখ ৭৯ হাজার প্রুফ লিটার। মদ বিক্রি হয় ৫৪ লাখ ৪৮ হাজার প্রুফ লিটার। যার বাজার মুল্য ৩৬৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। সরকারী কোষাগারে রাজস্ব জমা দেয় ১১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ডিস্টিলারির লাভ হয় ১৩২ কোটি টাকা। ৩০ বছর পর  কেরুর ৯টি কৃষি খামার ও একটি পরীক্ষামূলক খামার থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে লাভ হয়েছে ২০ লাখ টাকা। গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে লোকসান হয়েছিল ৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। খামার গুলো থেকে বীজ আখ উৎপাদন করা হয়। জৈব সার কারখানায় ১৬০২ মেট্রিক টন সার উৎপাদন হয়েছে। বিক্রি হয়েছে ৯৫৮ মেট্রিক টন। জেলায় ৩৮০২ একর জমিতে আখ চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে কেরুর নিজস্ব খামারে আখ রয়েছে ১১৫৩ একর। কৃষকরা চাষ করছেন ২৬৪৯ একর জমিতে। প্রতি মণ আখ কেরু কর্তৃপক্ষ এ অর্থ বছরে ক্রয় করবে ২২০ টাকা মণ। আর ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ক্রয় করবে ২৪০ টাকা প্রতি মণ। কেরুর জমিতে আখ চাষের সাথে সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা হয় আলু, মসুর, সরিষা, ধনিয়া ও মিষ্টকুমড়া। চিনি, পরীক্ষামুলক খামার, ডিস্টিলারি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ভিনেগার ও জৈব সার উৎপাদন করে থাকে রাষ্ট্রায়াত্ত এ কোম্পানিটি। দেশে কেরুর ১৩টি ওয়্যারহাউস ও ৩টি বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানির শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ সবুজ বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মিলটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আখ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। মিলটি দেশের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গত ৩০ বছর পর কৃষি খামার গুলো লাভ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ফুরশেদপুর কৃষি খামার ইনচার্জ মোঃ এমদাদুল হক ও ডিহি খামার ইনচার্জ মোঃ আফতাবুজ্জামান বলেন বিগত বছর গুলোতে আখের সাথে সাথি ফসল করা হতো না। কিন্তু এবছর  আখের সাথে আধুনিক পদ্ধতিতে সাথী ফসল করার করণে সাথী ফসল থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার অধিক মুনাফা এসেছে এবং বিগত মৌসুমের চেয়ে ২০২২-২৩ মৌসুমে আখের গড় ফলন একর প্রতি ৬ টন বেশি হওয়ায় কৃষি খামারগুলো লাভ করেছে। তিনি আরো বলেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন কৃষি খাবারগুলোতে আখের ফলন বৃদ্ধির লক্ষে ৩টি নতুন বৈদ্যুতিক গভীর নলকূল স্থাপন করেছে যার কারণে চলতি বছর আখের গড় ফলন আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবিষয়ে কেরু এ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন জানান, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৮০ কোটি টাকা লাভ হয়েছে। চিনি কলের লোকসান সমন্বয় করা হয়েছে। রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব জমা দেওয়া হয়েছে। গত অর্থ বছরের চেয়ে লাভ হয়েছে ১৩ কোটি টাকারও বেশি। আখ উৎপাদন ও মিলের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছি নিয়মিত। কৃষকদের আখ চাষে আগ্রহী করে তুলতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আখের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। কৃষি খামার ৩০ বছর পর লাভের মুখ দেখলো। একমাত্র চিনি কারখানা ছাড়া সব ইউনিট লাভজনক। মদ উৎপাদন ও বিক্রি অনেক বেশি হয়েছে। সবার সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

আরও পড়ুন