পচা শামুকে পা কাটা
প্রকাশিত: ১২-৭-২০২৩ দুপুর ২:৪৭
খুব প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে তা হচ্ছে ‘পচা শামুকে পা কাটা’। এই প্রবাদটির অর্থ আমরা কম বেশি সবাই জানি। কিন্তু সত্যি সত্যিই এর অর্থ কতটুকু অনুধাবন করতে পারি তা ঠিক আমার জানা নেই। তবে প্রায়ই অনেকেই প্রবাদটি কথায় কথাই ব্যবহার করে থাকেন। শামুক আমরা সবাই চিনি। যদিও এই প্রজন্মের নাগরিক মানুষেরা কতটুকু চেনে তা খোঁজ করে দেখতে হবে। তবে গ্রামীণ জনপদের ছোট বড় সকলেই কম বেশি শামুক চেনে। খালে, বিলে, ধানখেতে জমা পানিতে শামুক দেখা যায়। গ্রামে যারা হাঁস পালেন তারা খাদ্য হিসেবে শামুককে অগ্রাধিকার দেয়। কারণ এতে প্রচুর প্রোটিন আছে যা খেলে হাঁস দ্রুত বড় হয় এবং বেশি ডিম দেয়। তাছাড়া আমাদের অনেক নৃতাত্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের পছন্দের খাবার শামুক, ঝিনুক। দেশের বাইরে অনেকের প্রিয় খাবার এদুটি জিনিস। আমি দেশের বাইরে ঝিনুক খেয়েছি কিন্তু শামুক খাইনি।
সে যাইহোক এমন একটা জিনিস কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তা শুধু সেই জানে যার পা শামুকের ভাঙা খোলে কেটেছে। এরা সাধারণত তৃণভোজী। তবে কিছু শামুক সমুদ্রে থাকে তারা মাংসাশী হয়। স্থলচর শামুকদের মাথায় দুইজোড়া কর্ষিকা থাকে যা দরকার পড়লে গুটিয়ে নেয়। এর খোল থাকে স্পাইরাল বা প্যাঁচের আকারে তৈরি।
এত গেল শামুক যে কতটা নিরীহ প্রাণী সেই কথা। কিন্তু মৃত শামুকের ভাঙা খোল যেকোনো মানুষের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এতে পা কাটলে জীবন সংশয় পর্যন্ত হতে পারে। নিদেন পক্ষে এর ইনফেকশনে দীর্ঘদিন আপনাকে ব্যথার কষ্ট সহ্য করতে হবে কোনো কারণ ছাড়াই। আপনি তো শামুক ধরতে যাননি বা খেতেও যাননি। শুধুমাত্র অসাবধানতার কারণে আপনাকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে । কারণ আপনি পথচলার সময় খেয়াল করেননি যে পথে এই মারাত্মক জিনিসটা পড়ে আছে।
ঠিক সমাজেও এমন অহরহ পচা শামুকের মত মানুষের দ্বারা সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্নের ঘটনা ঘটছে। পচা শামুকের মত নিরীহ চেহারা নিয়ে আপনার আমার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। আমরা ধারণাও করতে পারছি না যে এই ব্যক্তিরা কতটুকু মারাত্মক। তারা পরিচিত, বন্ধু, কলিগ, প্রেমিক, প্রতিবেশী, বস, নেতা, আত্মীয় এমনকি আপনার চরম বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল হতে পারে। আপনি সরল বিশ্বাসে তার ওপরে আস্থা রাখলেন। কিন্তু সে বা তারা আপনার বিশ্বাস চরমভাবে পদদলিত করে আপনার ক্ষতি করার জন্য প্রস্তুত থাকে সবসময়। আপনি বুঝতেও পারবেন না কি চতুর আপনার কাছের এই মানুষটি ।
এই শ্রেণির মানুষ ওই পচা শামুকের মতো হয়ে উঠতে পারে আপনার জীবনে যেকোনো সময়ে।
আমরা অনেক সময় শুনি বা দেখি দুই/তিন বন্ধু মিলে কোনো ব্যবসা শুরু করেছে। দেখা যায় যে বন্ধু বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে, খেটেছে তাকে ঠকিয়ে পচা শামুক বন্ধুটি সবকিছু হাতিয়ে নিয়েছে। আসলে যিনি বিশ্বাস করেছেন তার পা কেটে সেপটিক হবার যোগাড়। মজার ব্যাপার হলো শুধু পা কাটে, হাত কাটে না?
আসলে যে মানুষগুলো শামুকের ভূমিকা পালন করে তারা অনেক নীচ মানসিকতার। আর তাই হয়তো পায়ের কথা বলা হয়েছে। অত্যন্ত নীচ নাহলে তো যে বন্ধু তার আয় রোজগারের পথ করে দিল তাকে তো ঠকাতে পারে না।
যে কোনো প্রবাদ একদিনে তৈরি হয় না। প্রবাদ, প্রবচন মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফল। সমাজে সবসময় এ ধরনের পচা শামুক মানুষের উপস্থিতি আছে, থাকবে। কিন্তু সমস্যা হলো বর্তমানে এর সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, মানুষ আর অমানুষ চেনা দায় হয়ে পড়েছে। এই শ্রেণির তথাকথিত মানুষ, তথাকথিত মানুষ বলছি এই কারণে, আমি তাদের মানুষ বলতে চাই না। অন্য কি নাম দেয়া যায় ভেবে দেখতে হবে। পশু এদের বলা যায় না। কারণ কোনো পশুই তাদের মত আপনজনের সাথে প্রতারণা করে না। যাক যা বলছিলাম তা হচ্ছে এদের সংখ্যা ভয়ানক ভাবে বেড়ে গেছে ফলে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়েছে সমাজে। যৌথভাবে কোনো কাজ করতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ফলে সমাজ নিয়ে যারা এখনো ভাবে, মানুষকে বিশ্বাস করতে চায় তারা পড়েছে ফ্যাসাদে। সে ব্যবসা বাণিজ্য হোক বা মানুষের উন্নয়নের জন্য কোনো কাজ হোক। এমনকি কেউ সত্যিকারের অসুবিধায় পড়ে সাহায্য চাইলে সাহায্যের হাত বাড়াতে একশতবার ভাবছে। প্রতারক কি না! এতে করে সমাজে এক ধরনের অবিশ্বাস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আমরা যারা সমাজে বাস করি তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সর্ম্পকে আবদ্ধ এবং দায়বদ্ধ। কিন্তু এখন আবদ্ধ হলেও দায়বদ্ধতা নাই বললেই চলে। আর এ কারণেই কোনো সর্ম্পককেই আমরা সম্মান দিচ্ছি না। কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করি না বা করছি না। খুব সহজে সর্ম্পকগুলোকে ম্যানিপুলেট করে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছি। এ এক নতুন ধরনের প্রতারণা। সেই প্রতারক শামুক মানুষের পচা স্পর্শে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ আমজনতা। যারা বিশ্বাস করে এইসব মানুষের কাছে তার সর্বস্ব তুলে দিচ্ছে। আমি বলছি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন কোম্পানির কথা যারা বেশি লাভ দেবে বলে সাধারণ মানুষের কাছে মিষ্টি কথা বলে। সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে। তারপর তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না।
সর্ম্পকের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে এই পচা শামুকেরা। নারী ,,পুরুষ নির্বিশেষে সব পচা শামুক, সর্ম্পকের মায়াজালে ফেলে নিজের আখের গোছাচ্ছে। এরা মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ব্যবসায় নামে। যখন যেমন প্রয়োজন সেই ভূমিকায় অভিনয় করে। ধূর্ত এই মানুষগুলো তাদের পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যায়। টার্গেট হাসিল করতে পারলেই নতুন ধান্দা শুরু করে। এই ডিজিটাল যুগে খুব সহজেই প্রতারণার কাজ করতে পারে। নিজের অন্যায়কে লুকাতে ফোন বন্ধ করে দেয়, ব্লক করে অথবা অন্যপক্ষের নামে কুরুচিপূর্ণ কথা ছড়ায়। চরিত্র নিয়ে কথা বলে। এটা এইসব শামুক মানুষের প্রধান অস্ত্র।
প্রতিদিন বিভিন্ন ভাবে তাদের প্রতারণার খবর শুনি বা জানি । কিন্তু কয়টি খবরই বা বাইরে আসে। অনেকেই নিজের বোকামির খবর প্রকাশ করতে চায় না। তাছাড়া এই বিষয়গুলোতে সঠিক বিচার হয় না। অধিকাংশ সময় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ প্রতারক মানুষটি থেকে দূরে সরে যেয়ে সমাধান খোঁজে। কিন্তু এটাতো সমাধান হতে পারে না। এদের শাস্তি হওয়া উচিত। শাস্তি হলে অন্তত যারা প্রতারণা করছে সাধারণ মানুষের সাথে তারা প্রতারণা করা থেকে বিরত থাকবে। ফলে কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে বলেই মনে হয়।
অন্যদিকে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেইভাবে একটি শিশুকে গড়ে তুলবে যাতে করে তারা ন্যায় অন্যায় সর্ম্পকে ধারণা মনের ভেতর নিয়ে বড় হয়। পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। শিশুকে যদি পরিবার নৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা না দিতে পারে, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য শেখাতে না পারে তাহলে বাবা-মা হওয়ার দায়িত্ব তারা কতটুকু পালন করেছে সেটাও ভাবনার বিষয়। এখানে বলতেই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে না। মনে করে খাওয়া পরার ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলেই সব করা হয়। ন্যায়, অন্যায়, মিথ্যাবলা, স্বার্থের জন্য অন্যকে ঠকানো একজন মানুষ কখনো করতে পারে না আর করলে সে বা তারা মানুষ হয় না। যদিও দেখতে মানুষের মতো হলেও। আর এইসব সন্তানরা মানুষ ঠকাতে একবারও ভাবে না। মানুষ ঠকানো তাদের উপার্জনের একমাত্র পথ হয়। তাই পরিবারের অনেক দায়িত্ব একটি শিশুকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। পচা শামুক হিসাবে নয়।
পচা শামুকের কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম। আসলে সমাজের প্রচলিত এই প্রবাদটি বর্তমানে ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। নাগরিক জীবনে শামুকের অস্তিত্ব তেমনভাবে না থাকলেও মানুষরুপী শামুকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলে এই শহরেও একফালি বাগানে শামুকের দেখা মেলে। তবে মানুষরুপী শামুক কিন্তু আপনার চারপাশেই আছে। এই মানুষগুলো অন্যের ক্ষতি করে ভাবে নিজেরা সফল হয়েছে। কিন্তু না তা কখনো হতেই পারে না। তাহলে পৃথিবীর অনেক কিছুই বৃথা হয়ে যেত। সর্ম্পকের বিশ্বাস একেবারেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এখনো বন্ধুত্ব, আত্মীয়, প্রেম, সুহৃদ, সহকর্মী, পাশে পাওয়া প্রতিবেশী আছে, এখনো আছে। সংখ্যায় কমে গেলেও। তাই পচা শামুক মানুষদের শাস্তি একদিন হবেই। সেটা সময় বলে দেবে। আমরা খবরের পাতায় তা দেখছি প্রতিনিয়ত ।
তাই বিশ্বাসের জোর অনেক বেশি। পচা শামুকের কাজ মানুষকে ব্যথা দেওয়া। তা নিরাময়ের জন্য আছে সামাজিক বন্ধন এবং ভালোবাসাই পারে এইসব পচা শামুক মানুষদের শাস্তি দিতে। শাস্তি তাদের প্রাপ্য। সে কারণেই শামুকের স্থান পথেই। নীচ মানসিকতা তাদের প্রধান সম্বল। আর ভদ্রবেশী চেহারা এবং মিষ্টি কথা যার সবই মিথ্যা, প্রতারণার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
মানুষের অভিজ্ঞতা লব্ধ এই প্রবাদ যুগ যুগ ধরে কথায়, লেখায় ব্যবহার হয়ে আসছে যা এখনো সমানভাবে প্রয়োগযোগ্য। আমরা সর্তক থাকি যেন। পচা শামুকে পা না কাটি।