কর আদায়ে ‘এজেন্ট’

news paper

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১-৫-২০২৩ দুপুর ৪:৩

17Views

এবার গ্রামাঞ্চলকে করজালের আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ লক্ষে সংস্থাটি প্রাইভেট এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। এই কর্মীরা কর দেওয়ার যোগ্য মানুষকে কর প্রদানে উৎসাহিত করবেন। একই সঙ্গে তারা নতুন করদাতাদেরও সাহায্য করবেন এবং ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা এখনও কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সাহায্য করবেন। এ লক্ষ্যে তারা করদাতার বাড়িতে বাড়িতে হাজির হতে পারেন। 

জানা গেছে, দেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে; যা বাংলাদেশের গত দুই দশকের চমকপ্রদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে কর সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি কর সংগ্রহ এজেন্ট নিয়োগ করার কথা ভাবছে সরকার। এ উদ্যোগ আসন্ন অর্থবছরে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য রাজস্ব বোর্ডের কৌশলের একটি অংশ বলে জানা গেছে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে। উল্লেখ্য, রাজস্ব সংগ্রহের এই লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬.২ শতাংশ বেশি।

ব্যবসায়ীরা কমানোর দামি করলেও, নতুন বাজেটে কর্পোরেট করহার একই থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ বা ৪ লাখ টাকা করা হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তথ্যানুসারে, গ্রামাঞ্চলকে করজালের আওতায় আনতে এবং কর দেওয়ার যোগ্য মানুষকে কর প্রদানে উৎসাহিত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে কর এজেন্টরা নতুন করদাতাদেরও সাহায্য করবে। অথবা ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা এখনও কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সাহায্য করবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবটি আগামী ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে আসন্ন বাজেটের অর্থ বিলে ‘ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার (আইটিপি)’ নামে একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ইতিমধ্যে যার খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, বেসরকারি কর সংগ্রহ এজেন্ট নিয়োগের ধারণাটি নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলো থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্যাক্স প্রিপেয়াররা সাধারণ কর ফর্ম, ফাইল প্রস্তুত করেন বা প্রস্তুতে সহায়তা করেন। এমনকি অডিটকালে ও কর আদালতে সমস্যায় পড়লেও তারা করদাতাদের সাহায্য করতে পারেন। তবে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলকভাবে কর এজেন্ট নিয়োগ করা উচিত; যাতে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এ উদ্যোগ করদাতাদের মধ্যে কর কর্মকর্তাদের সম্পর্কে ভীতি কমাতে সাহায্য করতে পারে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। মজিদ আরও বলেন, কর এজেন্ট নিয়োগের ফলে বিপুলসংখ্যক নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশে কর এজেন্ট হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা এনবিআর থেকে নিবন্ধন পাবে এবং ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার নিয়োগ করবে। এই এজেন্টরা প্রশিক্ষণ পাবেন এবং পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবেন। তারা নতুন করদাতাদের খুঁজে বের করবেন এবং তাদের রিটার্ন দাখিল করতে সাহায্য করবেন। সেই রিটার্নগুলো অনলাইনে জমা দিতে হবে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, কর এজেন্টরা জীবন বিমা কোম্পানির এজেন্টের মতো কাজ করবে। তারা সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের তথ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রথমে নতুন করদাতা খুঁজে বের করবে। এরপর তাদের রিটার্ন জমা দিতে উদ্বুদ্ধ করবে, প্রয়োজনে রিটার্ন পূরণ করে দেবে। এর বিনিময়ে এজেন্টকে উৎসে কর ব্যতীত আদায়কৃত করের ১০ শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে; যার বড় অংশই ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপেয়াররা পাবেন। এ কমিশনের হার নির্ধারণ করবে এনবিআরের নিয়োগকৃত এজেন্টরা। নতুন করদাতা খোঁজার বিনিময়ে আগামী ৫ বছর এজেন্টদের কমিশন দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে এজেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে করদাতা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রথমত, করজাল বৃদ্ধির মাধ্যমে আয়কর আদায় বৃদ্ধি। কারণ দেশের উপজেলা-পৌরসভা পর্যায়ে করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও অনেকে কর দিচ্ছেন না, তাই কাক্সিক্ষত মাত্রায় রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। প্রায় ৮৮ লাখের বেশি টিআইএনধারী থাকলেও চলতি করবর্ষে রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ২৯ লাখ করদাতা। দ্বিতীয়ত, এতে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর অবশ্য সতর্ক করেছেন যে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগে এনবিআরের পদক্ষেপের ফলে একটি ‘দালাল শ্রেণি’ তৈরি হতে যেতে পারে। ফলে উদ্যোগটি বুমেরাং হতে পারে। যেহেতু কর সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত কমিশনই হবে তাদের একমাত্র আয়, তাই এজেন্টরা করদাতাদের যে পরিমাণ কর দেওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি কর দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে; অথবা করের পরিমাণ কমানোর বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে পারে। এনবিআরের সাবেক সদস্য (কর নীতি) আলমগীর হোসেন মনে করেন, করদাতার সংখ্যা বাড়াতে পরীক্ষামূলকভাবে কর আদায়ে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। তবে কর এজেন্টদের কতটা কর্তৃত্ব দেওয়া হবে এবং তাদের দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেবে; তা পুরোপুরি না জেনে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে দুই অর্থবছর পরে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর।ব্যক্তি শ্রেণিতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ অথবা ৪ লাখ টাকা করা হবে। এ বিষয়ে ১৪ মে বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এনবিআর করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা রাখতে চাচ্ছে। কারণ এ সীমা ৪ লাখ টাকা করা হলে অনেক করদাতা করজালের বাইরে চলে যাবেন। এতে কর আদায় কমে যাবে।

গত ১০ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এটি বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা করা হয় ৩ লাখ টাকা। গত ২ অর্থবছর যাবৎ ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা সে হিসেবে আয়কর দিয়ে আসছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ায়নি এনবিআর। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো-কমানো যতটা না রাজস্বনীতি-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত, তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাই করমুক্ত আয়ের সীমা কত হবে, সেটা সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে। তবে এনবিআর চায় এটি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হোক। এতে উভয়পক্ষই (করদাতা-এনবিআর) লাভবান হবে বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।

কর্পোরেট করহার অপরিবর্তিত থাকবে: তালিকাভুক্ত ও নন-লিস্টেড এবং এক-ব্যক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য কর্পোরেট করের হার আগামী বাজেটে অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র। যদিও গত পরপর তিন বাজেটে এই করহার কমানো হয়েছিল। বর্তমানে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য কর্পোরেট করহার ২০ শতাংশ, নন-লিস্টেড কোম্পানির জন্য তা ২৭.৫ শতাংশ এবং এক-ব্যক্তি কোম্পানির জন্য ২২.৫ শতাংশ। সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হবে ৫ লাখ কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি এবং দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশের সমান। এনবিআরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬.২ শতাংশ বেশি। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না-ও হতে পারে। তবে সরকার যদি এর কারণে রাজস্ব ব্যয় না বাড়ায়, তাহলে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা খুব একটা খারাপ হবে না। সরকার যদি ব্যয় বাড়ায়, তাহলে ব্যাংক ঋণ বাড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য করজাল সম্প্রসারণে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ এত উচ্চ লক্ষ্য নির্ধারণের ফলে কর কর্মকর্তারা লক্ষ্য পূরণে চাপে পড়তে পারেন। আর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে করদাতাদের ওপর।


আরও পড়ুন