সকল অপকর্মে ছাত্রলীগ
প্রকাশিত: ২৩-৩-২০২৩ দুপুর ৪:২২
* ছাত্রত্ব শেষ হলেও ক্যাম্পাসে অবস্থান
* শিক্ষার্থী নির্যাতন
* মাদকের কারবার ও সেবন
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তৃণমূলের কিছু নেতাকর্মী জড়িয়ে পড়েছেন এসব কাজে। এর মধ্যে ছাত্রত্ব শেষ হলেও ক্যাম্পাসে অবস্থান, হল দখল, সিট ও কমিটি বাণিজ্য, চাঁদা ও টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, মাদকের কারবার, মাদক সেবন, শিক্ষার্থী নির্যাতন-হয়রানির মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়ে এসব অনিয়ম দূর করার কথা বললেও তা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-তৃণমূল সংগঠনের কমিটি গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করেছে। ফলে ছাত্রদের নিয়ে ইতিবাচক কর্মসূচির পরিবর্তে দেশজুড়ে বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন একশ্রেণির নেতাকর্মী। এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নিচ্ছে ছাত্রলীগ। অনেক সময় সাময়িক বহিষ্কারের মতো লঘু শাস্তি দিয়ে পরবর্তীকালে আবার স্বপদে বহাল করা হচ্ছে অপরাধীদের। এতে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠছেন নেতাকর্মীরা। আর তাদের এমন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়ছে মূল দলের ভাবমূর্তিতেও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে একটি কক্ষে আটকে চার ছাত্রকে টানা একদিন এক রাত নির্যাতন করা হয়েছে। এ অভিযোগ নির্যাতনকারী ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। প্রতিটি অঘটনেই আসছে তাদের নাম। ওমর গণি এম ই এস কলেজের অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষিকাকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন এক ছাত্রলীগ নেতা। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে ফের পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক শিক্ষককে গালাগাল ও দেখে নেয়ার হুমকি দেয় ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে আন্দোলনরত চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও এক নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায়ও জড়িত ছাত্রলীগ। পছন্দের প্রার্থীকে শিক্ষক পদে চাকরি না দেওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি অফিসে হানা দিয়ে ভাঙচুরের সাথে জড়িত হয় ছাত্রলীগ। গত কয়েক দিনে সংগঠিত এসব ঘটনায় চট্টগ্রামজুড়ে তোলপাড় চলছে। অথচ নিজেদের ছাত্র সংগঠনের এমন দুর্বৃত্তপনার লাগাম টানার ক্ষেত্রে নির্বিকার সরকারি দলের মন্ত্রী নেতারা। এর ফলে অপকর্মে ছাত্রলীগের রীতিমত বেপরোয়া আচরণে অসহায় প্রশাসন।
গত ২০ মার্চ বিছানায় শুয়ে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক। দুই পাশে বসে পা টিপছেন সংগঠনটির অপর দুই নেতা। এমন একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের অনেকেই সমালোচনা করছেন। তবে রেজাউল হকের দাবি, তিনি অসুস্থ থাকায় ওই দুই নেতা তাঁকে সেবা করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের ৩১১ নম্বর কক্ষ থেকে তোলা। তিন আসনের এ কক্ষ দখল করে একাই থাকেন রেজাউল হক। যদিও তাঁর ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে প্রায় এক দশক আগে।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রেজাউল হক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন প্রায় ১৭ বছর আগে, ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে। তিনি স্নাতক পাস করেন ২০১০ সালে। স্নাতকোত্তর পাস করেছেন ২০১৩ সালে।এছাড়া কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ছাত্রাবাসে চারজনকে রাতভর পিটিয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে পাঠানো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থীকে কক্ষে আটকে মারধর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) যুবককে অচেতন করে অর্থ আত্মসাৎ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে চাঁদা আদায়, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে পিটিয়ে স্বর্ণালংকার ছিনতাই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় কাভার্ড ভ্যান আটকে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মীর টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন দেশজুড়ে আলোচনায়।
এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর দক্ষিণের থানা ওয়ার্ডে চিহ্নিত মাদক কারবারীরা কমিটি পদ পাচ্ছে।গত ১৮ মার্চ রাজধানীর সুবজবাগ থানার ৪নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের এক নেতার মাদক সেবনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ ম্যধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।তিনি ওই ওয়ার্ড কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ এর সবুজবাগ থানার ৪ নং ওয়ার্ডে গত ১৮ মার্চ এক বছরের জন্য ৪৪ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করে থানা ছাত্রলীগ। ওই কমিটিতে অনেকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সবুজবাগ এলাকায় কিশোরগ্যাং পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে মামুনের বিরুদ্ধে। স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, এই ছেলে সিনিয়র জুনিয়র মানে না। এর আগে কোনোদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তাকে দেখা যায়নি।
আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিষয় সবুজবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মেজবা উদ্দিন পাভেল বলেন, কেউ যদি এই কমিটিতে মাদক সংশ্লিষ্ট হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর এই আ্দুল্লাহ আল মামুনকে পদের জন্য সুপারিশ করেছেন সবুজবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শোভন আহমে সুজন। এ ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদক শোভন আহমেদকে বার বার কল করেও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘যতদিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আওয়ামী লীগ নিজেদের সংগঠন বলে দাবি করবে, ততদিন তাদের সব কার্যক্রমের দায় আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। কাগজ-কলমে যাই থাকুক না কেন, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন এটা সবাই জানি। কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে এটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয়ের দায়ই দলটিকে নিতে হবে। এখানে ঝাড়া দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। দেশজুড়ে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এগুলোর জন্য দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর যাতে এগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয় তার নিশ্চয়তা এই দলকেই দিতে হবে। আর না হলে বলতে হবে, তারা আমাদের কেউই না, পুলিশ যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প আমি দেখি না।’ তিনি আরও বলেন, এটা তো সরকারের জন্যও অস্বস্তিদায়ক বিষয় হওয়ার কথা। কারণ সরকারের যে উন্নয়নের কথা আমরা শুনছি বা দেখছি, সেগুলো ম্লান করে দিতে পারে এ ধরনের কার্যক্রম। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী তো সবসময় এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেন। ছাত্রলীগ ছাত্রদের হাতে কলম তুলে দিয়েছেন, অস্ত্র তুলে দেননি- এটা তিনি বলেন। কিন্তু তারা তো (ছাত্রলীগ) এই কথার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। এগুলো প্রধানমন্ত্রীরও বিবেচনার বিষয়।’
জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নামে যেসব কথা আসে তা প্রধানত দুটো কারণে হয়। একটি রাজনৈতিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং অন্যটি ক্ষমতার দাপট থেকে। রাজনৈতিক ক্ষোভের ঘটনাগুলোর পেছনে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট থাকায় তা রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। তবে ক্ষমতার দাপট থেকে যেই ঘটনাগুলো ঘটে সেগুলো সহজেই সমাধান করা যায়। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ ছাত্র যেই মত বা পথেরই হোক না কেন, অন্য ছাত্র বা কোনো ব্যক্তি তার গায়ে হাত দিতে পারে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বন্ধে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতাদেরও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের দায়-দায়িত্ব আছে। ছাত্রলীগের কেউ যদি শিক্ষাঙ্গণ বা এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট করে সেটা দেখার দায়িত্বও তাদের রয়েছে। শিবিরের কেউ ছদ্মবেশে ঢুকে কিছু করছে কিনা সেই বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতার একজন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ছাত্রলীগ বিশাল ছাত্র সংগঠন। এখানে সবাই ‘দুধে ধোয়া তুলসী পাতা’ তা আমরা বলছি না। এখানে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। আর এমন হলে যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে অহেতুক ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করার একটা চেষ্টা থাকে। কারণ তারা জানে, ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করতে পারলে আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করা যায়। পত্রিকায় ছাত্রলীগকে নিয়ে যেসব সংবাদ আসে তার ৮০ শতাংশই সঠিক নয়। ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রদের নিয়ে কমিটি গঠন এই সংগঠনের একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। আগামী সম্মেলন নিয়েও ছাত্রলীগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে বলে জানতে পেরেছি।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের সভাপতি ছাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনানকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা তা রিসিভ করেননি।