দুর্নীতির আখড়া কাস্টম হাউস

news paper

চট্টগ্রাম ব্যুরো

প্রকাশিত: ৮-২-২০২৩ দুপুর ১১:৫২

255Views

 আমদানি রপ্তানির অন্যতম রুট হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে এখানে প্রতিনিয়ত আদায় করা হচ্ছে মোটা অংকের ঘুষের টাকা। কোন ব্যবসায়ী ঘুষ দিতে না চাইলে নানা অযুহাতে শুরু হয় পণ্য খালাসে ভোগান্তি। ফলে গুনতে হয় অতিরিক্ত জরিমানা আর এসবের কারনে ভোক্তা পর্যায়ে এসে পণ্যের দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বি। এর ফলে একদিকে যেমন ম্লান হয়ে যাচ্ছে সরকারের ভালো কাজের সুনাম অন্যদিকে বিপুল পরিমান রাজস্বও হারাচ্ছে।  একাধিক বিশ্বস্ত সুত্রে এসব অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। 

জানা যায়, আমদানি করা মালামাল নিয়ে জাহাজ বন্দরে আসার পর কাস্টম হাউসের অটোমেশন সিস্টেমে অনলাইনে বিল অব এন্ট্রি (আগাম চালান) দাখিল করতে হয়। তারপর আইজিএম, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, এলসি কপি, এলসিএ, ইন্স্যুরেন্স কপি, মেরিন পলিসি, কান্ট্রি অব অরিজিন সনদ ও বিল অব এক্সচেঞ্জের মূল কপি নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রুপের অ্যাপ্রেইজারের কাছে সশরীরে যেতে হয়। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে বন্ডের পণ্য হলে জেটির ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্টে ফাইল পাঠানো হয়। ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে সহকারী কমিশনারের কাছে ফাইল নিতে হয়। তিনি পণ্য পরীক্ষার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। ওই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুষ দিতে হয়। তারপর বন্দর নিয়োজিত ইয়ার্ড ক্লার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনটেইনার খোলার অনুমতি নিতে হয়। খালাসের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে কন্টেইনার প্রতি অতিরিক্ত ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। আর কোনো কারণে ডকুমেন্টে ছোটখাটো ভুল থাকলে ওাই স্পিডমানির পরিমাণ অন্তত তিনগুণ বেড়ে যায়। শুলকায়নের জন্য নির্ধারিত কোড অনুযায়ী সরকারী রাজস্ব পরিশোধের পর মিলে খালাসের অনুমতি। কেউ ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন ঘুড়েও খালাসের অনুমতি পাওয়া যায়না। আবার কর্মকর্তাদের চাহিদা অনযায়ী ঘুষের টাকা পরিশোধ করলে রাজস্ব কম দিলেও খালাসের অনুমতি পেয়ে যায়। ফলে হয়রানির ভয়ে অনেকেই অতিরিক্ত ঘুষ দিতে বাধ্য হন। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে গড়ে ১০ দিন সময় লাগার কথা থাকলেও ঘুষ বাণিজ্যের ফলে কিছু কিছু জাহাজ খালাসে এক মাসের বেশি সময়ও ক্ষেপণ করে থাকেন। আবার অন্য একটি চক্র আছে যারা চোরাই পণ্য পাচারের সাথে জড়িত, তারা তাদের চাহিদা মোতাবেক ঘুষের টাকা পেলে অনায়াসেই চোরাই পণ্য খালাসের অনুমতি দিয়ে থাকেন। গত বছরে জেটি থেকে বের হওয়ার পর এরকম বিপুল পরিমান চোরাই পণ্য আটক করেছিল র‌্যাব। 

আবার পণ্য খালাসে নির্ধারিত সময়ের বেশি পার হলে গুনতে হয় কন্টেইনার ও জাহাজের অলস সময়ের জন্য অতিরিক্ত জরিমানা। এর ফলে জরিমানা, পণ্যের ক্রয়মুল্য ও ঘুষের টাকাসহ হিসেব করে নির্ধারণ করা হয় পণ্যের বাজার মুল্য। আর এসবের ফলে পণ্যের প্রকৃত মুল্যের চেয়ে কয়েক গুন দাম বেড়ে যায়। ফলে খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ে। আর ভোক্তা সরকারের উপর দোষ দিয়ে বিভিন্নভাবে সমালোচনার ঝড় তুলতে থাকে।

বছরের পর বছর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এমন অনিয়ম চলমান। মাঝে মাঝে ২/১ টা অভিযানে এর সত্যতা পাওয়া গেলেও ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করা যাচ্ছেনা।  সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের এক অভিযানে এসব অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে বলে জানিরয়েছে দুদক। এ বিষয়ে অভিযানে নেতৃত্বদানকারী দুদক চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক এনামুল হক বলেন, দুদক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রাম কাস্টমসে অভিযান চালানো হয়। সকাল থেকে ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া অবলোকন করা হয়। এ সময় ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। অসাধু কর্মকর্তাদের পছন্দসই দালাল চক্রের মাধ্যমে এখানে ঘুষ লেনদেন হয় বলে জানান দুদকের এই কর্মকর্তা। এছাড়া কাস্টমসের রাসায়নিক ল্যাবের কার্যক্রমেও নানা অসঙ্গতি দেখা গেছে। এর ফলে রাজস্বের পরিমান কমছে। উৎসাহিত হচ্ছে চোরাকারবারীরা। অভিযোগের বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়ার কাজ চলমান আছে।

এছাড়া শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ ঢাকা কাস্টম হাউসও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসকে কেন্দ্র করে চলছে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাই পণ্য খালাসের মহোৎসব। মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ঘুষের দাবিকৃত টাকা না পেলে মাসের পর মাস আটক রাখা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের পণ্য। এককথায় ব্যবসায়ীরা জিম্মি। আর ঘুষের বিনিময়ে চোরাই পণ্য ঠিকই দ্রুত খালাস করে দেয়া হচ্ছে। ফলে সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে এনবিআরের অধীনে চট্টগ্রামসহ ৬টি বড় কাস্টম হাউস রয়েছে। আর ছোট শুল্ক স্টেশন ১৮৪টি। তার মধ্যে সক্রিয় শুল্ক স্টেশনের সংখ্যা ৩৭টি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, কমলাপুর আইসিডি ও ঢাকা কাস্টম হাউস আংশিক অটোমেটেড চালু হলেও বাকিগুলো এখনো তার বাইরে রয়েছে। যদিও ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানিমুক্ত পরিবেশে ও কম সময়ে রপ্তানিপণ্য খালাস করতে পারে ওই লক্ষ্যে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগকে প্রায় ৯ বছর আগে কাগজবিহীন বা পেপারলেস করার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এখনো কাস্টমস বিভাগের অধীনে দেশের কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনগুলো প্রচলিত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলছে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ধীরগতিতে হচ্ছে। ফলে এখনো ব্যবসায়ীদের পণ্যের শ্রেণীকরণ বা এইচএস কোড নিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে কাস্টমস বিভাগের পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট থেকে শুরু করে শুল্কায়নের সব কার্যক্রম কাগজ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বন্দরে পণ্য শুল্কায়ন ও খালাসে হয়রানি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। একই সঙ্গে তারা বন্দর ও কাস্টমসের সক্ষমতা বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছে। তাদের মতে, তা না হলে অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সক্ষমতায় দেশ পিছিয়ে পড়বে। তবে সম্প্রতি এনবিআরের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেশের প্রধান বন্দরগুলো থেকে আমদানি পণ্য খালাসের সময় কমিয়ে আনতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশে স্মার্ট কাস্টম হাউস ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ দেশকে চীন, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ভিয়েতনামের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কাস্টম হাউসে পণ্য শুল্কায়ন ও খালাস কাজ দ্রততম সময়ের মধ্যে করা জরুরি। কারণ বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর হয়রানি করে শুধু কর আদায় করে বিশ্বে কোনো দেশের উন্নত হওয়ার নজির নেই। 

 ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের মতে, বন্দরে আমদানি পণ্য আসার পর তা কোন শ্রেণির তা নির্ধারণ নিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমদানিকারকের প্রায়ই বাগবিতণ্ডা হয়। তাতে পণ্য খালাসে কালক্ষেপণ হয়। ওই জটিলতা নিরসন হওয়া জরুরি। বর্তমানে একটি কাস্টমস হাউসে গড়ে দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নথি ব্যবহার করা হয়। সব কাস্টম হাউস পুরোপুরি অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় হলে কাগজের কোনো ফাইল থাকবে না। তাতে পণ্য খালাসের সময় বাঁচবে এবং দুর্নীতি কমবে। ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও গতিশীল হবে।

এবিষয়ে কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ঘুষ বাণিজ্যের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তাদের চাহিদা মোতাবেক ঘুষ না দিলে পণ্য খালাসে নানা রকম টালবাহানা শুরু করে কাল ক্ষেপণ করতে থাকে। এতে ভোগান্তিতে পড়ে ব্যবসায়ীরা। আবার অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে চোরাই পণ্যও খালাস করে দিতে পারে এই চক্রটি। এসব কর্মকর্তারা একদিকে যেমন আমাদের হয়রানি করছে অন্যদিকে সরকারকেও রাজস্ব বঞ্চিত করছে। এদের হয়ারনির ফলে বাজারে অনেক পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে, যার ফলে সরকারও বিতর্কিত হচ্ছে। বন্দর বা কাস্টমস হাউস থেকে পণ্য খালাস করতে বেশি সময় লাগার কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। 
এব্যপারে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি এস এম নাজের হোছাইন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিত্য ভোগ্যপণ্য ছাড়াও অনেক কাঁচামালও আমদানি হয়ে থাকে। এসব আমদানির সাথে যাবতীয় খরচ ব্যবসায়ীরা ব্যয়ের সাথে সমন্বয় করে পণ্যের মুল্য নির্ধারণ করবে। খরচটা কিভাবে হল তা বড় কথা নয় কত খরচ হলো সেটাই মূখ্য বিষয়। কোন ব্যসায়ী লসে পণ্য বিক্রি করবে না, সকল খরচ বাদ দিয়ে একটা লাভ ধরেই ভোক্তার কাছে পণ্য পৌছাবে। সুতরাং পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায় রাখতে সকল ধরণের অনিয়ম রোধ করা জরুরী বলে মনে করছি। প্রয়োজনে যেসব ব্যক্তি অপকর্মে জড়িত তাদের সনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। 
এসব অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজের সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. ফাইজুর রহমানের অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তাঁর দুটি মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার কল ও বার্তা দিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি।


আরও পড়ুন