পাবনাসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপে জনজীবন বিপর্যস্ত
প্রকাশিত: ১০-১-২০২৩ দুপুর ১১:৭
পাবনাসহ গোটা উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় শীতের দাপটে সমস্ত প্রাণীকুল যুবুথুবু হয়ে পড়েছে। শীতের তীব্রতায় কাবু হয়ে পড়েছে মানুষ। শীতের ধকল কাটছে না পাবনাসহ গোটা উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায়। বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত ৮দিনে শুধুমাত্র পাবনা জেনারেল হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছে ৫৪২ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু।
কুয়াশার কারণে কয়েক দিন ধরে দুপুরের আগে সূর্যই দেখা যায়নি। সামনে কী আছে দেখা যায় না বলে হাইওয়েতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। দিন দিন তাপমাত্রা শুধুই কমছে। মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়ে মানুষসহ সকল প্রাণীকুল টরম দুর্ভোগে পড়েছে। সোমবারর সারা দিনই এ অঞ্চলে একই রকমের শৈত্যপ্রবাহ চলে বলে ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডা বাতাসের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। প্রচন্ড শীতের তীব্রতায় বিপাকে পড়েছে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষেরা। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। সূর্যের দেখা মিললেও তার নিরুত্তাপ আলো শীতার্ত মানুষের শরীরে উষ্ণতা ছড়াতে পারছে না। এমন বৈরি আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী মানুষ।
কনকনে শীতে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিরার শীতে কষ্ট পাচ্ছে। এক কথায় সমস্ত প্রাণীকূলশীতের তীব্রতায় যুবুথুবু হয়ে পড়েছে। ঘন কুয়াশা ও শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। চলতি মাসের শুরু থেকে সোমবার (০৯ জানুয়ারি) পর্যন্ত জেলায় ৮ ডিগ্রি থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়ামের মধ্যে ওঠানামা করছে। সোমবার পাবনা অঞ্চলের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।পাবনার ঈশ^রদী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মোঃ নাজমুল হক জানান, চলতি শীত মৌসুমে এ অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রোববার (০৮ জানুয়ারী) ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া চলতি মাসের ১ জানুয়ারী ছিল ১৩ ডিগ্রি, ২ জানুয়ারি ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি, ৩ জানুয়ারি ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি, ৪ জানুয়ারি ১০ ডিগ্রি, ৫ জানুয়ারি ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি, ৬ জানুয়ারি ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি এবং ৭ জানুয়ারি ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়ার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
সোমবার (০৯ জানুয়ারি) পাবনায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।। গত ৫দিন ধরে পাবনায় তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রির সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করছে বলে ঈশ্বরদী আবহাওয়া দপ্তরের পর্যবেক্ষক কর্মকর্তা নাজমুল হক জানিয়েছেন।
এদিকে গরম কাপড়ের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে গরীব অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলো। সকালে কনকনে শীত ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো কুয়াশার কারণে বোরো ধান রোপণে কৃষি শ্রমিকেরা কাজ করতে পারছেনা। দূর থেকে আসা অনেকেই কাজ না করে ফিরে যাচ্ছেন। এ রকম বিরুপ আবহাওয়ার কারণে ক্ষেতের ফসল নষ্টের আশঙ্কা করছে কৃষকরা।
পাবনা সদর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের কৃষক জহুরুল ইসলাম, ক্ষুদ্র মাটিয়া গ্রামের স্বপন কুমার বিশ্বাস, ভজেন্দ্রপুর গ্রামের জাকারিয়া হোসেন, টেবুনিয়ার বাবুল হোসেন জানান,‘প্রচন্ড শীতের কারণে বোরো বীজতলা ও সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্খা করা হচ্ছে।
এদিকে, প্রচন্ড ঠান্ডায় বৃদ্ধ ও শিশুদের মধ্যে সর্দিজ্বর, আমাশয়, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।ভূমিহীন ও রাস্তার ফুটপাতে শুয়ে যাদের জীবন কাটে তাদেরকে এই হিম শীতে মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় কষ্ট পাচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই। সকাল থেকে ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় হাড় কেঁপে উঠছে। বেড়েছে ভাসমান মানুষের দুঃখ কষ্ট। বেলা করে কুয়াশা থাকায় প্রতিদিন তাপমাত্রা কমছে। দিন রাত যেন সমান তালে থাকছে শীত।
শীতের কারণে গরম কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে ছোট-বড় মার্কেট ও সপিংমলে চাদর, কম্বল, জ্যাকেট সোয়েটার, কার্ডিগান, হাতমোজা, কানটুপিসহ বিভিন্ন ধরণের গরম কাপড় বিক্রি বেড়েছে বিগত বছরগুলোর চেয়ে কয়েকগুন। বিত্তবানরা ছুঁটছেন শহরের বড় বিপণী-বিতানগুলোয়। আর নিম্ন আয়ের মানুষ গরম কাপড় কিনতে ফুটপাতের দোকানে ভিড় করছেন।
পাবনা শহরের হকার্স মার্কেটের গরম কাপড় ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম সাহা জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশি। শীতের তীব্রতা যত বাড়ছে গরম কাপড়ের চাহিদাও তত বাড়ছে। পাবনা মধ্য শহরে সোনালী ব্যাংকের সামনে ফুটপাতের ভাসমান ব্যবসায়ী কহিনুর রহমান জানান, শীতের কারণে ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ শ’ টাকা পর্যন্ত দামে শীতের কাপড় বিক্রি হচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বেচাকেনা হচ্ছে দেদারছে।
তিনি জানান, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাই বেশি ভিড় জামাচ্ছেন। সেই সাথে ভ্যান চালকসহ অসহায় শীতার্ত মানুষও কম দামে শীতবস্ত্র ক্রয় করছেন। পুরনো এ সকল শীতের কাপড় কিনতে মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখেই বোঝা যায়, শীত কতটা তীব্র আকার ধারণ করেছে।সিভিল সার্জন ডাঃ মনীসার চৌধুরী বলেন, উপ-হিমালয় অঞ্চলে হাড়-ঠান্ডা শৈত্যপ্রবাহের কারণে নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা, বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষ এবং শিশু, সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
পাবনা আড়াই শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগে সিনিয়র নার্স নুরজাহান বেগম বলেন, প্রতিদিন এতো পরিমান ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু রোগী আসছে যে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।এ বিভাগের (শিশু বিভাগ) বিশেষজ্ঞ মাহমুদুর রশীদ বলেন, শীতের কারণে মানুষের নিউমোনিয়া, সর্দি, জ্বর, কাশি, আমাশয় রোগ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন ডায়রিয়ার আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক শিশু হাসপাতালে আসছে। অনেকে ভর্তি হচ্ছে আবার অনেককে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হছে। তবে এতো বড় হাসপাতালে মাত্র ১৫টি বেড রয়েছে ডায়রিয়া ইউনিটে। সেখানে চলতি বছর জানুয়ারি ১ তারিখ থেকে ৮ তারিখ দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বেড ও করিডোরে ডায়রিয়া রোগীর সংখা ছিল ৫৪২। রোববার (০৮ জানুয়ারি) এ সময় পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছিল ৪৩ জন। পর্যাপ্ত ডায়রিয়া বেড বরাদ্দ থাকা দরকার বলে চিকিৎসক, নার্স ও ভূক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
পাবনা জেলা ত্রাণ ও পূণর্বাসর কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল করিম জানান,‘সরকারিভাবে জেলার বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত ৪০ হাজার ৭শ’ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৪০ হাজার শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।’ এ অঞ্চলে চলছে প্রচন্ড শীত। শীতের তীব্রতায় বিপাকে পড়েছে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষেরা। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। এসব অসহায়দের মুখে হাসি ফোটাতে এখনো এগিয়ে আসেনি মানব দরদী নামধারী বহু এনজিও।