ঝিনাইদহে ঘুস-দুর্নীতির বিচারহীনতায় দুর্নীতি কমছে না বরং উৎসাহিত হচ্ছে

news paper

শামীমুল ইসলাম শামীম, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: ২৫-১১-২০২২ দুপুর ৩:২০

44Views

মানুষ দুর্নীতির শিকার।দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে। বড় দুর্নীতির বিচার না হলে ছোট দুর্নীতি উৎসাহিত হয়।কোটি কোটি শতকোটি, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে।দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে শাস্তির সম্ভব নয়।‘সরকারি-বেসরকারি সব খাতেই দুর্নীতি হচ্ছে। দেশ তথা ঝিনাইদহ জেলা থেকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যারা দুর্নীতি করে, অন্যায় করে যারা কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন, তাদের সাজা দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘুস-দুর্নীতি, অনৈতিক আর্থিক কর্মকান্ড সবই চলে এখন প্রকাশ্যে। আইনের ফাঁক-ফোকরে এবং অনেক সময় আইনের দুর্বলতার কারণে দুর্নীতিবাজদের সাজা হচ্ছে না। আইনের ফাঁক গলে শত শত অপরাধী দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ‘ঘুস দুর্নীতিতে আজ কলুষিত সমাজ’ ঘুস দুর্নীতির ফলে যারা অন্যায় করছে তাদের সাজা দেয়ার ব্যবস্থাও হারিয়ে যাচ্ছে।দুর্নীতিবাজদের তদন্ত  প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় অনেক সময় দুর্নীতিবাজদের বিচার হচ্ছে না ফলে দুর্নীতির চিত্র বাড়ছে।দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেটা শুধু দেখানোর জন্য। বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না। প্রকারন্তেরে এটা বাড়ছে। এটার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

ঝিনাইদহের মানুষ বিভিন্ন সরকারি-বে-সরকারি দপ্তরে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হতে হচ্ছে পাসপোর্ট অফিস,সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস,খাদ্য গুদাম অফিস,পিআইও অফিস,হাসপাতাল, বিআরটিএ , সরকারি স্বাস্থ্য সেবা , স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ,জেলা জুড়ে স্কুল-কলেজে নিয়োগ বানিজ্য, নায়েব অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস,ভূমি নাম খারিজ অফিস থেকে সেবা নিতে গিয়ে মানুষদের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে।
ঝিনাইদহের বিভিন্ন সরকারি ও নানা দপ্তরে বেশুমার লুটপাট ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। বিগত বছরগুলোতে ঝিনাইদহের বেশ কয়েকটি দপ্তরে কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য ও প্রমাণ মিলেছে। 

ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার ভবানীপুর জনতা ব্যাংকে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এনআইডি ব্যবহার করে ওই এলাকার শতাধিক কৃষকের নামে ভৌতিক ঋণ দেখিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। গত সেপ্টম্বর মাসে জনতা ব্যাংকের হেড অফিস থেকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি সরজমিন তদন্ত করে ঋণ জালিয়াতির সত্যতা পান। তবে টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির পরিবর্তে বদলি করা হয়। ভবানীপুর ব্যাংকের সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা ইউনুস আলী ও রুরাল ক্রেডিট অফিসার আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ। ব্যাংকের এই বেহাল দশার পর ঝিনাইদহ পৌরসভা ও শৈলকুপা পৌরসভায় ঘটেছে অর্থ তছরুপের ঘটনা। ঝিনাইদহ পৌরসভায় চেক জালিয়াতি করে ৭৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ঘটনাটি তদন্ত করে প্রমাণ পান ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক দপ্তরের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ইয়ারুল ইসলাম। মন্ত্রণালয়ে তিনি তদন্ত  প্রতিবেদন জমা দিলে এ ঘটনায় সাবেক পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা আজমল হোসেন ও হিসাবরক্ষক মকলেচুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। ঝিনাইদহ পৌরসভার চেক জালিয়াতির রেশ কাটতে না কাটতে শৈলকুপা পৌরসভায় ৫ বছরে পৌর কর ফান্ডে জমা না দিয়ে ২৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ঘটনায় প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে কর আদায়কারী সাজ্জাদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঝিনাইদহসহ চার জেলার দায়িত্বে থাকা মৎস্য বিভাগের মহা দুর্নীতিবাজ উপ-সহকারী প্রকৌশলী সোহেল আহম্মেদের বিরুদ্ধে ঠিকাদারী কাজ দেওয়ার নাম করে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। মৎস্য বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সোহেল এখন টাকার কুমির। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মো. মোহায়মেন আক্তারের বিরুদ্ধে রাজস্ব খাতের কৃষকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ।দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার আমিনা বেগম ও তার স্বামীরসহ তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করতে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আমিনা বেগম চাকরিতে যোগদানের পর বিভিন্ন সময় দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি এবং তার স্বামী রুবাইয়াত আনোয়ার ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা নামে বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।

শৈলকুপা উপজেলায় আবারও ভয়াভয়ো ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে ভূমি  রেজিষ্ট্রি জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।যার দলিল নাম্বার ৬০৪০/২১ সাল,রেজিষ্ট্রি তারিখঃ৩১/১০/২০২১,জমির পরিমান ২৯.৫০শতক।গ্রহীতাঃ নাইমূল ইসলাম নোমান গং পিতাঃফরিদুল ইসলাম ভুন্ডুলে ভূমিদস্যু জালিয়াতকারি।দাতাঃরোকসানা ইসলাম লাবনী গং পিতাঃ মৃতঃ রেজাউল ইসলাম টুকু।সর্বসাং হাটফাজিলপুর।শৈরকুপা উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার ইয়াসমিন শিকদার , দলিল লেখক চর আউশিয়া গ্রামের মোঃ বাবুল আক্তার,পিতা-মোঃ ইয়াকুব আলী, সনদ নাম্বার ১৩২ এবং দলিল সনাক্তকারি শিক্ষক মাহাবুবুল ইসলাম জুয়েল এর যোগসাজশে ব্যাপক ঘুষ বানিজ্যের মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের জমি রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে। 

শৈলকুপা উপজেলার বেষ্টপুর গ্রামের ছেলে যশোর ডি.আর অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন মোঃ ইব্রাহীম হোসেন বাবুল,বর্তমানে জেলা রেজিস্ট্রারের কার্য্যালয় কুষ্টিয়াতে প্রধান সহকারী হিসাবে কর্মরত আছেন।যাহার মোবাইল নাম্বার ০১৭১৮-৪৪৫১২১।ঘুষ-দুর্নীতি ও ভূমি জালিয়াতির দুর্নীতির মাধ্যমে অসৎ উপায়ে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক বনে গেছেন। দুর্নীতির এই বরপুত্র এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে,তিনি কর্মক্ষেত্রে এখনো বহালতবিয়তে রয়েছেন। যশোর ডি.আর অফিসে কর্মরত থাকাবস্থায় দলিল জালিয়াতি সিন্ডিকেট এর যোগসাজশে যশোর ডিআর অফিসের দলিলের রেকর্ড ভোলিয়াম বই থেকে শৈলকুপা উপজেলার ১৬৯নং পৌজার হাটফাজিলপুর এলাকার গ্রহিতা রেজাউল ইসলাম ও দাতাঃ ফরিদুল ইসলাম, দলিল নং ১১৩৯/৮১ , রেজিষ্ট্রি তারিখঃ ২০/০১/১৯৮১ সালের দলিলটি যশোর সাব-রেজিষ্ট্রি (ডি.আর)অফিসের তৎকালিন বড় বাবু ,শৈলকুপার ১৩নং উমেদপুর ইউনিয়নের বেষ্টপুর গ্রামের ইব্রাহীম হোসেন বাবুলের  সহযোগিতায় ভোলিয়াম বই থেকে ১১৩৯/৮১ নং  দলিলের সব পাতা ব্যাপক টাকার বিনিময়ে ছিড়ে ফেলতে সক্ষম হন । ইব্রাহীম হোসেন বাবুল জাল দলিলসহ বহুবিধ জালিয়াতির কাজ ব্যাপক টাকার বিনিময়ে করে থাকেন। 
এদিকে রেজিষ্ট্রি জালিয়াতির ঘটনায় যশোর দু’দক অফিসের কর্মকর্তা বাদী হয়ে শৈলকুপা থানায় তৎকালিন কর্মরত শৈলকুপার সাব রেজিষ্টারের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন।যাহার মামলা নং  ০৬/২৬০ তারিখ ১০/১১/২০১৪। দুনীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোর এর ই/আর নং ২০/২০১০ অনুসন্ধান কালে, আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর অনুমতি প্রদান তারিখ ১৫/১০/২০১৪।জমির এস.এ দাগ নং ৩০৭৭, নির্মল কুমার এর কবলা দলিল নাম্বার ৬৫২০,তারিখ ০৪/১২/১৯৭২, ১৬৯নং হাটফাজিলপুর মৌজার।দলিল লেখক,ভুয়া দাতা,ব-কলমে স্বনাক্তকারিসহ মূল অপরাধিরা এখনও ধরাসোয়ার বাইরে। 
দুদকে মামলার জালিয়াতী দলিল নং ৫৬৮৬/০৯, তারিখ ২১/ ১২/০৯,দলিল নাম্বার ৫৬৮৫/০৯, তারিখ- ২১/১২/০৯ জালিয়াতী নাম পত্তন নং- ৫৮৯/১-১/০৯-১০ তারিখঃ ২৮/০৭/০৯ ইং।দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা মতে আসামীগন ১৩৫২ নং খতিয়ানের খরিজের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৩৫২/১ নম্বর খতিয়ানের ভূয়া পর্চা তৈরী করে ৫৬৮৫/০৯,এবং ৫৬৮৬/০৯ দলিল রেজিঃ সম্পন্ন করে প্রতারনা ও জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহন করায় শান্তি যোগ্য অপরাধ করেছেন মর্মে রেকর্ড পত্র দৃষ্টে প্রাথমিক ভাবে প্রতিয়মান হওয়ায় ,আসামী তৎকালীন শৈলকুপায় কর্মরত সাব রেজিষ্টার মোঃ মমিন উদ্দিন মন্ডল, পিতা নিজাম উদ্দীন মন্ডল ,থানা ভুরুঙ্গামারি ,জেলা কুড়িগ্রাম কে আসামী করে মামলা দায়ের করেন।বিচার বিহিন মামলাটি আজও অবদি শৈলকুপা থানায় থেকে যায়। 
শৈলকুপা সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের রেজিষ্ট্রি জালিয়াতী ১৬৯নং হাটফাজিলপুর মৌজার আরো দলিল নং- ৬৩০৫/১১, রেজিঃ তাং- ২৬/১২/১১ ইং জালিয়াতী নাম পত্তন নং-৪০/১ -১১/৮৯-৯০ ,জালিয়াতী হাল খতিয়ান বুজরাত নং১০৬০, ডিপি খতিয়ান নং ২৭।দলিল নং-২০৭১/১৪,রেজিষ্ট্রি তারিখ ২৮/০৪/২০১৪,দলিল নং ১৭৫০/১০ (দু’দক তদন্ত করে) রেজিষ্ট্রি তারিখ ২৩/০৩/২০১০,জালিয়াতি দলিল নং-৬৮৪০/৬৮ তাং-২৬/১২/১৯৬৮ ইং ।দুনীতি দমন কমিশন,প্রধান কার্যালয় ঢাকার স্বারক সংখ্যা ৪৪-২০১২ ঝিনাইদহ ২৪৪৭৮নং তারিখে ১৭/০৯/২০১২ খ্রিঃ।

এভাবে ঝিনাইদহের বিভিন্ন সরকারি ও অন্যান্য দপ্তরে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা চলমান থাকলেও ধরা পড়ার নজির খুবই কম। তদন্ত করলে অনেক সরকারি দপ্তরে লুটপাটের ভয়াবহ তথ্য মিলতে পারে। 
এ জেলাতে দেখা যায়, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে তার পদ বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা করা হয় না। তারা স্বপদে বহাল তবিয়তে থাকেন। তাদের দুর্নীতির তদন্তের প্রতিবেদন বছরের পর বছর আটকে থাকে। হাজার হাজার মানুষের স্বার্থের ক্ষতি করা হয়। এখানে একজন মানুষের স্বার্থ দেখতে গিয়ে ব্যাপক মানুষের বৃহত্তর স্বার্থের ক্ষতি করা হচ্ছে। দেখা যায় দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে যাচ্ছেন। অনেকেরই বিচার হয়েছে, এটা মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তির শাস্তি হলেও সেটা উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হচ্ছে না। 


আরও পড়ুন