বুয়েট শিক্ষার্থী সনি কিংবা দীপের অপরাধটা কোথায়?
প্রকাশিত: ৮-১০-২০২২ দুপুর ৩:৫৬
সনি, দীপ নামগুলো অনেকটা অপরিচিত লাগতেই পারে। ২০০২ এবং ২০১৩ আজ থেকে প্রায় ১০ কিংবা ২০ বছর আগের ঘটনা৷ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের আস্তানা হিসেবে স্বীকৃত বুয়েট রক্তাক্ত হয়েছিল তাদের রক্তে৷ ঠিক বিগত কয়েক বছর আগেই ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদ নামে এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সারাদেশে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়৷ এমতাবস্থায় নামধারী, বিপথগামী ছাত্রলীগকর্মীরা অন্যায়টি সংঘটিত করলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সরাসরি খুনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়৷ পরবর্তীতে আদালতের রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ অথচ সানি ও দীপরা একই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ছিল। সানির জন্য বিচারের নামে প্রহসনটুকুও করা হয়নি; বরং তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসন হত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
আরিফ দীপকে নিজ ক্যাম্পাসেই কুপিয়ে মারা হয়। অথচ বর্তমান তথা বিগত সময়গুলোতে আন্দোলনকারী কাউকে এদের বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি৷ কেননা, আবরারের লাশে ও বিচারহীনতার ধারাবাহিক চর্চায় তারা স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল ক্ষমতার, পাবলিসিটির৷ পাশাপাশি রাষ্ট্রবিরোধী মহলগুলোর আর্থিক লোভনীয় প্রস্তাবগুলো তো ছিলই। স্বার্থের রাজনীতির কাছে সুবিধা পেয়েছিল আবরার। ফলশ্রুতিতে বিচারের বাণী পৌঁছেছিল প্রয়াত আবরারের কাছে। যদিও সেখানে আকুণ্ঠ সমর্থন ছিল ছাত্রলীগ এমনকি বাঙালির আশা-ভরসার একমাত্র বাতিঘর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার। রাষ্ট্রীয় সুনীতি ও মানবিকতাই দেশরত্নের রাজনৈতিক দর্শন। তিনি দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলেন- ‘ছাত্রলীগ হোক আর যাই হোক, অপরাধীর পরিচয় একটাই- সে অপরাধী’।
বাস্তবিকভাবে একটি ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত। আবরারের প্রশ্নে যে মহলটি সোচ্চার, ঠিক দীপের প্রশ্নে তারা নিশ্চুপ। হয়তো দীপ ছাত্রলীগ করত কিংবা মুজিব আদর্শের সৈনিক ছিল বলেই৷ একজন শিক্ষার্থী হত্যা নিশ্চয়ই গুরুতর ও ক্ষমার অযোগ্য একটি অপরাধ। অপরাধ হলে বিচার হবে নিরপেক্ষতার সহিত, এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বরাবরই বিচারের প্রশ্নে আপসহীন, তখন অযথা প্রশ্ন তুলে জল ঘোলাটে করা নিশ্চয়ই অনুচিত কর্ম৷ সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দোষের কিছু নেই। কেননা, সানি ও দীপের ইতিহাস থেকেই হয়তো তারা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু যারা আবরাবের লাশকে রাজনৈতিক উপকরণ বানিয়েছে, তাদের কতটা সুস্থ বলবেন? পাবলিক সেন্টিমেন্ট স্বাভাবিকভাবেই পেয়েছে, ফলশ্রুতিতে পেছনে তাকাতে হয়নি৷ নিঃস্বার্থভাবে সাধারণ বুয়েট শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালে বিষয়টি মানানসই হতো। আরো বাস্তবিক হতো যদি দীপের প্রশ্নেও দাঁড়াত। দীপ কি জাতির সম্পদ নয়? নাকি ছাত্রলীগ করাই এদের দৃষ্টিতে ছিল অপরাধ।
এবার সানি ও দীপের হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসে একটু চোখ বোলানো যাক। আগেই বলে নেই, এ দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এমন কলঙ্কজনক ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। ২০০২ সালের মিড-টার্মের পর প্রথম দিনটি ছিল ৮ জুন। চলছে বিশ্বকাপ খেলা। খেলা দেখার জন্য স্বেচ্ছায় ছুটি নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর পৌনে ১টার দিকে বুয়েটের বিশাল অঙ্কের টেন্ডারকে কেন্দ্র করে মোকাম্মেল হায়াত খান মুকির নেতৃত্বে ছাত্রদল বুয়েটের একটা সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয় ঢাবির এসএম হলের আরেক সন্ত্রাসী টগর গ্রুপের সঙ্গে। অবিরাম গুলিবর্ষণের মধ্যে পড়ে আহসান উল্লাহ হলের সামনে সাবেকুন্নাহার সনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর বোন হত্যার বিচারের দাবিতে এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটা ধারাবাহিক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম রচনা করেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। দেশের সচেতন মানুষ ওই আন্দোলনে সমর্থন জানান। কিন্তু তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ওই সন্ত্রাসীদের রক্ষায় নির্লজ্জ ভূমিকা পালন করে। একটা নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ধারাবাহিক আন্দোলন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দৃঢ়তা, আন্দোলন দমনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আর রাষ্ট্রের নির্মম নির্যাতন আর অপকৌশল সবকিছুই আমাদের কাছে একটা বড় শিক্ষা। কারণ, ‘সনি’ সাধারণ এই একটি নামের মধ্যেই উদ্ভাসিত হয়ে আছে এক বিশাল চেতনা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অনির্বাণ আলোকবর্তিকা।
অন্যদিকে, ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ছাত্রলীগকর্মী আরিফ রায়হান দীপকে৷ দীপের মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত করা হয়, যার একটি বাম চোখের ওপর পড়ায় তা হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পিঠে এমনভাবে কোপানো হয়েছে যে, ৫০টির বেশি সেলাই দিতে হয়েছে বলে জানান চিকিৎসক। সে বুয়েটকে শিবিরেরর আস্তানা বানানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সরাসরি সে বজ্রকণ্ঠে রুখে দাঁড়িয়েছিল জামায়াত-হেফাজতের এজেন্ডার বিরুদ্ধে। সেদিন কিন্তু জামায়াত-শিবির এই হত্যাকাণ্ডকে 'নাস্তিকতাবিরোধী' জিহাদ বলে বাহবা দিয়েছিল, প্রতিবাদ তো দূরের কথা।
অন্যদিকে, আবরারের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতা খুবই জরুরি। সানি ও দীপ প্রকৃত বিচার পায়নি নানা জটিলতায় কিংবা নানা নোংরা রাজনৈতিক সমীকরণে। অথচ, বর্তমান সরকার আবরারের বিচারে বিষয়ে সচেষ্ট ছিল। এরূপ অবস্থায় যখনই বিচারহীনতার জাল ভাঙে তখনই বিপথগামী অপশক্তির একটি অংশ নতুন ফায়দা লোটার স্বপ্নে বিভোর হয়৷ বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। দেশের সর্বমহলে আলোচনা-সমলোচনার ঝড় বইতে শুরু করে৷ তথাকথিত একটি সুশীল মহল ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি উন্থাপন করে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এক্ষেত্রে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
বলা বাহুল্য, এক সময়কার প্রগতিশীল বুয়েট বিগত কয়েক দশক হতে নিষিদ্ধ জঙ্গি, জামায়াত-শিবির ও দেশদ্রোহী অপশক্তিদের স্থায়ী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এসব বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় নিউজও হয়েছে। পাশাপাশি বিপথগামী অধিকাংশ জঙ্গি নেতা ও বোমা প্রস্তুতকারী সদস্যরা বুয়েটের ছাত্র। এমনকি ছাত্রশিবিরের বিগত কয়েক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকদের প্রায় ৮৫ ভাগই বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল৷ অন্যদিকে করোনা পরবর্তী সময়ে ছাত্রদল বুয়েট শাখা কমিটি ঘোষণা করেছে সুপ্রিমকোর্টের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। বিগত কয়েক মাস আগে বুয়েটের ছাত্রলীগকর্মীরা জাতির পিতার এক স্মরণসভা করতে গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বাধা দেয় অপশক্তির সদস্যরা এবং হেনস্তা করে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তথা শ্রদ্ধেয় অগজদের।
অতএব, একটি বিষয় স্পষ্ট- তা হলো বুয়েটকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিশাল রাজনৈতিক ছক আঁকা হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আড়ালে বুয়েটে জঙ্গিবাদকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় শক্তি বা প্রতিবন্ধকতা হতে পারত ছাত্রলীগ৷ এ কারণেই পিতা মুজিবের হাতে গড়া সংগঠনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বুয়েট থেকে সংগঠনটির যাত্রা রুখতে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত আছে। আবরারের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে বিষয়টিকে সহজভাবে সামনে এনে রাজনৈতিক ফায়দা ভালোই হাসিল করতে সক্ষম হয়েছে গোষ্ঠীটি। ওরা ওদের উদ্দেশ্যতে সফল! হয়তো এক সময় অদূর ভবিষ্যতে বুয়েটের মতো সৃষ্টিশীল বৈজ্ঞানিক অঙ্গন থেকেই প্রকাশ্য নেতৃত্ব পাবে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো। এদের কাছে আবরারের লাশের অর্থ আবরারের মায়ের কান্না নয়; বরং সাময়িক ফায়দা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের৷ দীপের সমস্যা ওই যে একটাই, তিনি ছাত্রলীগ করতেন। লড়াইটা তো ছিল তাদের বিরুদ্ধেই। সুতরাং, বিচারের দাবিতে রাজপথ গরম করার যৌক্তিকতা এখানে নেই৷ বরং একটি আবর্জনা দূর হয়ে সৃষ্টি হয়েছে অবন্ধুর পথ।
বিচারহীনতা, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার; সবকিছুর পেছনেই নির্মম সত্য নোংরা রাজনীতির কালো ছায়া। বুয়েটকে পবিত্র করতে হলে রুখে দাঁড়াতে হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই অসাধারণ হয়ে সকল প্রকার অপশক্তির দ্বারা ব্যবহৃত না হয়ে৷ আবরারের বিচার তো হলো, তবে সানি ও দীপের প্রশ্নে দেরিই বা কেন?
লড়াইটা শুরু হোক সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই, যাদের কাছে মায়ের কান্না অমূল্য, ভাই বা সহপাঠী হারানোর আবেগ অসীম৷ প্রশ্ন তো একটাই, সানি ও দীপের অপরাধটা কোথায়? উত্তরটা হয়তো স্বার্থানেষী, দেশদ্রোহী মহলেরই জানা৷