ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় নাজুক শিক্ষা ব্যবস্থা

news paper

মজিবর রহমান, গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ৭-১০-২০২২ দুপুর ৩:১৩

15Views

কথায় আছে যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি ততো বেশি উন্নত। নদ-নদীবহুল জেলা গাইবান্ধার চরাঞ্চলে ১১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিক স্কুল ও মাদরাসা নেই বললেই চলে। ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। চরাঞ্চলে বসবাসরত বিশাল জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।

ব্রহ্মপুত্র যমুনা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন গাইবান্ধার  ফুলছড়ি উপজেলার চর চরাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়ন ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ী, ফুলছড়ি। এসব ইউনিয়নের বিশাল জনগোষ্ঠী কেবল শিক্ষাই নয়, বঞ্চিত সব রকমের সুযোগ-সুবিধা থেকেই। ফলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ঝরে পড়ছে অকালে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জেলার সামগ্রিক শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। আবার অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে বাল্যবিবাহসহ শিশুশ্রমে। এদিকে যে চরগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে, তার একটি তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। 

গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি,সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ এই চার উপজেলার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনায় জেগে ওঠা ছোট-বড় সব মিলিয়ে ১৬৫টি চর-দ্বীপচর রয়েছে এ জেলায়। নগণ্য শিক্ষার্থী ও কথিত ভাড়াটে শিক্ষক দিয়ে চলছে বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ের পর্যাপ্ত স্কুল না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় পাস করার পর ঝরে পড়ছে বেশির ভাগ শিশু। এদের মধ্যে ছেলেরা নিয়োজিত হচ্ছে কৃষিকাজে, মেয়েরা বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়ছে বাল্যবিবাহের।জেলার চরাঞ্চলে অন্তত চার লাখ মানুষ বসবাস। নদী তীর সংলগ্ন ১২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দুইটি মাদরাসা থাকলেও চরে নাই কোন প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এই চরাঞ্চলগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থাপনের দাবি অবিভাবকদের।

ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের চর কাবিলপুরচরের বাসিন্দা জুনাইদ সিদ্দিকি পড়েন গাইবান্ধা সরকারি কলেজে। তিনি জানান, ওই চর থেকে গত বছর ২৩ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করলেও হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে ৭ জন। চর এলাকায় হাই স্কুল না থাকাই ঝরে পড়ার মূল কারণ। মূল ভূখণ্ড উপজেলা কিংবা জেলা শহরে পড়তে হলে অনেক দূরের পথ অতিক্রম করতে হয়। অনেকেই হাই স্কুলে ভর্তি হলেও মাঝপথে ঝরে পড়ে যাতায়াত ও আবাসন সংকটের কারণে। মমেনা খাতুন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী গুনভরি উচ্চ বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ার পর যাতায়াত সমস্যার কারণে আর স্কুলমুখো হয়নি। সে বলেন, তার সঙ্গী হাসনা, রেখা ও তাহেরা ৫ম শ্রেনি পাশ করার পর কেউ আর স্কুলে যায়না। নদী পার হয়ে একা স্কুলে যেতে ভয় লাগে তার।

চর কাবিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবিউল হাসান জানায়, চরের শিশুদের লেখাপড়া করার অনেক ইচ্ছা থাকলেও আশপাশে হাই স্কুল না থাকায় বাধ্য হয়ে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতে হয় তাকে। কালাসোনা চরের তিন সন্তানের জনক হবিবুর রহমান (৬০)। তাঁর দুই ছেলে আলাল ও দুলাল। তারা পঞ্চম শ্রেনি পাস করার পর আর স্কুলে যাইতে পারে নাই। তারা এখন কৃষি কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করছেন। তৃতীয় সন্তান হাবিবা বাড়ির পাশে স্কুল থাকায় সে পড়ছে পঞ্চম শ্রেনিতে। এর পরে নদী পার হয়ে স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয় জানায় হবিবুর।
তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, হামরা গরিব মানুষ। বাহিরে নেখা পড়া করাইতে অতো ট্যাকা কই পামো। পড়াশুনার খরচা, নাও ভারা দেওন নাগে। নদী পার হতে গেলা কখন কী হয়। মেলা সমস্যা।

সরকারি পরিসংখ্যানে গাইবান্ধা জেলায় সাক্ষরতার হার ৬৬ ভাগ। চরাঞ্চলের শিক্ষার নিম্ন হারের কারণে জেলায় বাড়ছে দারিদ্র্য,বেকারত্ব,বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম। কথা হয় মানবাধীকার কর্মী আব্দুল কাদের ভূইয়া আকাশ’র সাথে। তিনি  জানান, দুর্গম চরে যাতায়াত সমস্যা প্রকট। মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ নেই। যেহেতু চরগুলো প্রায় নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সেক্ষেত্রে দুই তিনটি চরে মিলে ন্যূনতম  একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থাপন করা হলে ওইসব এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের অকালে ঝড়ে পড়া থেকে রক্ষা হতো। 

এব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন বলেন, ‘চরাঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যে কয়টি বিদ্যালয় আছে তা নদী তীর ঘেষে। আর যে চরগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার উপযোগী সেই চরগুলোর একটা তালিকা তৈরী করা হচ্ছে। তালিকাটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর হবে বলে জানান তিনি।  

জেলায় নদী তীর সংলগ্ন রয়েছে ২ টি মাদ্রাসাসহ ১৪ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এর তথ্য অনুযায়ী চরে ১১৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এই চরাঞ্চল থেকে ৯৮ ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাথমিকের গণ্ডি পাস করলেও অর্ধেকে তা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভর্তি হতে পারেন না ।

পর্যাপ্ত মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষেই থমকে যাচ্ছে ফুলছড়ি সহ গাইবান্ধার চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া। শিক্ষা সুযোগ বঞ্চিত হয়ে বাড়ছে মেয়েদের বাল্যবিবাহ আর শিশুশ্রম এমন কি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ছেলেরা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, দুই তিনটি চর এলাকার সাথে সমন্বয়ে মাধ্যমিক স্কুল হলে চরে উন্মোচিত হতে পারে শিক্ষার নতুন দিগন্ত।


আরও পড়ুন