৪ জুলাই হোক পদ্মা সেতু দিবস

news paper

মো. নূর হাকিম

প্রকাশিত: ২৫-৬-২০২২ দুপুর ৪:৩৭

11Views

আমাদের দেশে কয়েকটি জাতীয় দিবস পালন করা হয়। যেমন- ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (শহীদ দিবস), ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দিন জাতীয় শোক দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়। যেমন- মা দিবস, বাবা দিবস, ভালোবাসা দিবস, মে দিবস ইত্যাদি। এমন অসংখ্য দিবস বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় উদযাপন করে থাকে। তেমনিভাবে ৪ জুলাই পদ্মা সেতু দিবস উদযাপন করা হোক। আর এটা করা হোক জাতীয়ভাবে। কেননা, আজ প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে যে সেতু দাঁড়িয়ে আছে, তার ভিত রচনা করা হয় ২১ বছর আগে, অর্থাৎ ২০০১ সালে। ওই বছরের ৪ জুলাই তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেখানে সুধী সমাবেশে বক্তব্যও রাখেন তিনি। সেদিন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও শেখ হাসিনা এ সেতুর স্বপ্ন দেখেছিলেন তারও অনেক আগে। ১৯৯৮ সালে তিনি ফরিদপুরে জনসভায় এ সেতু নির্মাণের কথা বলেন।

পদ্মা সেতু বিশ্বের বুকে আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবে। এ সেতু সাহসের প্রতীকও বটে। অদম্য বাঙালি জাতিকে যে কোনোভাবেই দাবিয়ে রাখা যায় না; এ সেতু কিন্তু তারই প্রমাণ। অনুন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা মধ্যম আয়ের দেশের পক্ষে নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন আর কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। শুধু যে নিজ অর্থায়নে হয়েছে, বিষয়টি সেখানেই শেষ নয়। এ সেতু নিয়ে হয়েছে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। অর্থায়নের খবর নেই; দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। এর প্রেসিডেন্ট জোয়েলিক শেষ কর্মদিবসে বন্ধ করে দেন অর্থায়ন। (পরে দুদকের তদন্ত এবং কানাডার আদালতে বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণ হয়)। প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। তখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এই প্রথম বিশ^ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছে। প্রকল্পের ভাগ্য এখন অনিশ্চিত।’

কিন্তু অদম্য, উদ্যমী, স্বাধীন চেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, সেতু হবে। নিজেদের অর্থায়নে হবে। তখন হয়তো তার কথায় অনেকেই আস্থা রাখতে পারেননি; কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন উন্নয়ন কিভাবে করতে হয়। ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক বড় বড় প্রকল্প আমরা নিজেদের অর্থে করতে পারব। এতে দুটো লাভ হবে- ১. বিদেশি নির্ভরতা কমবে; ২. আমাদের দেনাও কমবে। বিশ্বের বুকে স্বনির্ভর হিসেবে আমাদের মর্যাদা বাড়বে।

পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রী সরাসরি দায়ী করেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তিনি যদি সেটা করেই থাকেন, তবে তা দেশের জন্য শাপেবর হয়েছে। বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাকে দায়ী করেন। ড. ইউনূস কখনো এর প্রতিবাদ করেননি। এতে আমরা ধরেই নিতে পারি তিনি অর্থায়ন বন্ধের জন্য দায়ী। কারণ মৌনতা যে সম্মতির লক্ষণ।

এ তো গেল ষড়যন্ত্রের কথা। এবার আসা যাক গুজব প্রসঙ্গে। ২০১৫ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়। এই প্রকল্পের মূল সেতু নির্মাণের কাজ পায় চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এতে চীনের প্রায় ১৫০ প্রকৌশলী এবং ৩৫০ কর্মী যোগ দেন। ২০১৫ সালের ১ মার্চ মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় মূল সেতুর পরীক্ষামূলক ভিত্তি স্থাপনের সময় নদীতে গরু ও খাসির রক্ত ঢালতে দেখা যায় চীনা কর্মীদের। ভাসিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি মুরগিও। এটা চীনাদের প্রচলিত রীতি ও বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস- বড় কোনো কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গ করলে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। চীনা ওই রীতি নিয়ে বড় কোনো আলোচনা তখন হয়নি। তবে ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে শুরু হয় গুজব। সোশাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়, পদ্মা সেতু তৈরিতে ‘মানুষের মাথা লাগবে’।

এই গুজবের পালে হাওয়া পায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই নেত্রকোনায় এক যুবকের ব্যাগে একটি শিশুর মাথা পাওয়ার পর। স্থানীয়দের সন্দেহ হয়, পদ্মা সেতুতে বলি দেওয়ার জন্য ওই যুবক কাটা মাথা সংগ্রহ করছিল। ওই যুবক গণপিটুনিতে নিহত হয়। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ছেলে ধরার গুজব। দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত হয় নিরীহ মানুষ। ওই বছরের ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর তথ্য জানতে স্থানীয় একটি স্কুলে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেনু নামের এক নারী। তাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটুনিতে এক ব্যক্তি নিহত হন। একই জেলায় আরেক স্থানে এক নারী হন পিটুনির শিকার। ২১ জুলাই মিনু মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি টাঙ্গাইলের কালিহাতীর সয়া হাটে মাছ ধরার জাল কিনতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে জনতার পিটুনিতে নিহত হন। সেই গুজব ও ষড়যন্ত্র এখনো চলছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলছেন, দেশের মানুষকে (বানভাসী) অভুক্ত রেখে সরকার পদ্মা সেতু উৎসবে মেতে ওঠেছে। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন- ২০০১ সালে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বেগম খালেদা জিয়া। জাতীয় সংসদে একই দাবি করেন বিএনপির সংসদ সদস্য জি এম সিরাজ। তিনি পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে উৎসব আয়োজনের সমালোচনা করে বলেন, বন্যায় মানুষের দুর্দশায় সরকারের খেয়াল নেই। এখন তারা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের উৎসব উন্মাদনায় মত্ত। তিনি বলেন, উৎসব উদযাপনে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু দেশের বর্তমান দুর্গত মানুষের দুঃখ দুর্দশায় এই উৎসব করাটা অমানবিক ও বেমানান বৈকি। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে শুভ উদ্বোধন করুন। তবে উল্লাসের মাত্রাহীন উন্মাদনা দয়া করে বন্ধ করুন। এ সময় সরকারি দলের সদস্যরা হইচই করে বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। তবে বিএনপির শাসনামলের যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেন, খালেদা জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেননি। 

ফিল্ম আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালের ৪ জুলাই (বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১৪০৮ বঙ্গাব্দের ২০ আষাঢ়) প্রথমবারের মতো মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক (প্রয়াত), তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উপলক্ষে সেদিন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় যে স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে, সেখানেও ছাপা হয়েছে ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাণী। এর একটি কপি আছে আমাদের হাতে।

তখনকার খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর ভাষ্য, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু করার জন্য জাপানিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। তারা অর্থায়নের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিলে তিনি সমীক্ষাও শুরু করেন এবং স্থান নির্বাচন করেন। প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে কেবিনেটে আলোচনা করেন। সে আলোচনা মোতাবেক তিনি ২০০১ সালে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেখানে মন্ত্রিসভার সদস্য, স্থানীয় নেতাকর্মী এবং দাতা সংস্থার লোকজনও উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনা। সে মেয়াদে তার একান্ত ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তার ভাষ্য, ১৯৯৮ সালে ফরিদপুরের একটি জনসভায় প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের কথা বলেন।

এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে জাপানিদের সঙ্গে অর্থায়নের বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা সাপেক্ষে সমীক্ষা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০০১ সালে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সরকারি নথিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে। সে সময় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য একটি সরকারি চিঠি জারি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (একান্ত ব্যক্তিগত সহকারি-২) হিসেবে আমি সেই চিঠি নথিবদ্ধ করি। কিন্তু তার কয়েকদিন পরই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এ কাজ আর এগোয়নি। পরবর্তীতে ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর সহকারি প্রেস সচিব আশরাফ সিদ্দিকী বিটুর একটি কলাম থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করে। ২০১১ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে। কিন্তু কথিত দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন থেকে পিছিয়ে যায় বিশ্বব্যাংক। নানা অভিযোগ ষড়যন্ত্র চাপ উপেক্ষা করে ২০১২-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। ২০১২ সালের ৪ জুলাই সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ জুলাই আবারও সংসদে দাঁড়িয়ে ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে’ বলে জানিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ জাতির সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি। ২০১৫-এর ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।


আরও পড়ুন