টাঙ্গাইলে প্রকাশ্যেই ব্যাটারি গলিয়ে তৈরি হচ্ছে সিসা, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বিশাল জনগোষ্ঠী

news paper

রাশেদ খান মেনন, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৪-৬-২০২২ দুপুর ৪:৪৯

127Views

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ঘোষপাড়া চারাবাড়ী এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে ব্যাটারি পুড়িয়ে একটি অবৈধ সিসা তৈরি করতে স্থাপন করা হয়েছে অনুমোদনহীন একটি কারখানা। এখানে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই প্রকাশ্যেই পুরাতন ব্যাটারি ভেঙে পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া এই কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে।
 
পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো. মাহবুবুল হক এর মতে, এ ধরনের উন্মুক্ত স্থানে সীসা পোড়ানোর ফলে জীব-বৈচিত্র্য ও মানুষের খাদ্য চক্রে ঢুকে পড়ছে ভারী ও অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ সীসা। এভাবে ব্যাটারি ভাঙ্গা এবং সীসা গলানোর সময় ক্ষুদ্রকণা বাতাসে ও মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। 
 
সরেজমিন দেখা যায়, সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়নের ঘোষপাড়া (এসডিএস ব্রিজ সংলগ্ন) এলাকায় পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। দশ জন শ্রমিক ও কর্মচারী পুরাতন ব্যাটারি ভেঙে প্লেট আলাদা করছে। ব্যাটারির পরিত্যক্ত অংশ আলাদা করে রাখা হয়েছে যত্রতত্র। এই দশজন  শ্রমিক খালি গায়ে ও খালি হাতে কোন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই তারা দিনরাত এই কাজ করে যাচ্ছে এই কারখানায়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে কোনো সাইনবোর্ড, ট্রেড লাইসেন্স, কলকারখানা অধিদপ্তরের সার্টিফিকেট, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির নিরাপদ চুল্লি নেই। ফ্যাক্টরির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পরিত্যক্ত ব্যাটারির বর্জ্য প্লাস্টিক, কার্বন ও ক্ষতিকারক বিভিন্ন ধরনের পদার্থ।
 
সরেজমিন টাঙ্গাইলের একটি বেসরকারি পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম লাগানো একটি হাফ টনের পিকআপে কারখানায় উৎপাদিত প্রায় ১২০ কেজি সিসা ঢাকায় চায়না ফ্যাক্টরিতে পাঠানোর দৃশ্য দেখা গেছে।
 
কারখানার কর্মচারী শাহাদাৎ জানান, তিনিসহ মোট দশজন কর্মচারী উত্তরবঙ্গ থেকে এখানে এসেছেন কাজ করতে। মালিকের নির্দেশেই তারা এভাবে ব্যাটারি ভেঙে তা পুড়িয়ে সিসা তৈরি করছেন। মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও পেটের দায়ে এ কাজ করছেন তারা। 
 
তিনি আরো জানান, দিনের বেলায় ব্যাটারি ভাঙা হয় আর রাতে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়। তাদের ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করার কোনো চুল্লি নেই। তাই বাধ্য হয়েই উন্মুক্ত স্থানে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হচ্ছে। 
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বেশ কয়েকজন জানান, ব্যাটারি কারখানার মালিক দুজন টাঙ্গাইলের ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতার নিকটাত্মীয়। ফলে এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ উপেক্ষা করেই দীর্ঘদিন ধরে কারখানাটি চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে রাতে যখন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয় তখন এলাকাবাসীর শ্বাস-প্রশ্বাসে ভীষণ কষ্ট হয়। 
 
তারা আরো জানান, ব্যাটারি পোড়ানোর স্থানে কোনো ছাউনি না থাকায় বৃষ্টি হলেই, বৃষ্টির পানির সাথে বিষাক্ত বর্জ্য পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পাশের ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ে। এক সময় ধলেশ্বরী নদীর এই অংশে প্রচুর মাছ পাওয়া গেলেও কারখানা চালুর পর থেকেই এখানে কোনো ধরনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
 
এ প্রসঙ্গে কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন মিয়া প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও পরে জানান, আপনারা খুব ভালো করেই জানেন কারখানাটির মালিক কারা। স্থানীয় এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের চাপ থাকা সত্ত্বেও কারখানাটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এমনকি ব্যবসা পরিচালনার জন্য ওই কারখানার মালিক ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো ট্রেড লাইসেন্সও গ্রহণ করেননি। তিনি ফ্যাক্টরি বন্ধে নিজের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেন।
 
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দীন জানান, এই অবৈধ ফ্যাক্টরির বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে এভাবে প্রকাশ্যে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করলে বায়ুদূষণ ও আশপাশে বসবাসরত প্রাণীর মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর ইতোমধ্যে দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নে একটি অবৈধ ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির কারখানা উচ্ছেদ করেছেন। যত দ্রুত সম্ভব এই অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
 
টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রানুয়ারা খাতুন জানান, তিনি বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের ফেসবুক লাইভে এই অবৈধ কারখানার বিষয়ে জেনেছেন। যত দ্রুত সম্ভব এই অবৈধ কারখানা উচ্ছেদে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
 
উন্মুক্ত স্থানে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভারমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রফেসর ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড মো. মাহবুবুল হক বলেন, সিসা একটি ভারী ও নিউরো  টক্সিক পদার্থ যা মানুষের সরাসরি সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্ক, কিডনি ও লিভারে বিশেষ ক্ষতিসাধন করে। উন্মুক্ত স্থানে সিসা পোড়ানোর ব্যাপারে  একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। এই নীতিমালার অধীনে সিসা উৎপাদন ও বিপণনে কঠোর তদারকি দরকার। উন্মুক্ত স্থানে ব্যাটারি পোড়ানোর ফলে এই ভারী ও বিষাক্ত পদার্থ সিসা আমাদের খাদ্যচক্র ও জীবনচক্রে ঢুকে পড়ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
 
উল্লেখ্য, দীর্ঘ সময় ধরে পুরনো ও পরিত্যক্ত ব্যাটারি থেকে সিসা আহরণ কারখানাগুলো দেশে নিদারুণ দূষণ ও প্রাণহানি ঘটিয়ে চলেছে। এসব কারখানা গড়ে উঠছে দেশের সর্বত্র কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। মানছে না বিদ্যমান পরিবেশ আইন। জনস্বাস্থ্য, প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র তছনছ করে দিচ্ছে। শালবন থেকে হাওর, পাহাড় থেকে নদী অববাহিকা, কৃষিজমি থেকে বন্দর নানা স্থানে গড়ে ওঠা এসব ব্যাটারি কারখানার মাধ্যমে মানুষসহ প্রাণীর শরীরে ঢুকছে সিসার বিষ, প্রতিবেশ ব্যবস্থায় ঘটছে গোলমাল। সব ব্যাটারি কারখানাই গড়ে উঠেছে বসতি এলাকায়।
 
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ব্যাটারি কারখানার অধিকাংশেরই কোনো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই, কারখানায় পরিবেশ আইন অনুযায়ী কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি নেই। মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব কারখানাকে জরিমানা করছে কিংবা সিলগালা করে বন্ধ করে দিচ্ছে। এভাবে দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা পুরনো ব্যাটারি কারখানার মাধ্যমে যদি দেশের সর্বত্র সিসার বিষ ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা গবাদি প্রাণিসম্পদ, মানুষ থেকে শুরু করে প্রকৃতিতে তৈরি করবে এক নিদারুণ বিশৃঙ্খলা। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেছেন। 

আরও পড়ুন