ভোলায় ৫৫০ বছরের নান্দনিক প্রাচীন স্থাপত্য সংরক্ষণের দাবি
প্রকাশিত: ২৭-২-২০২২ দুপুর ১:৩
ভোলা জেলা সদর হতে ৩০ কিলোমিটার এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদর হতে ৭-৮ কিলোমিটার দক্ষিণে সাচড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে গুড়িন্দা বাড়িতে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জেলার ৫৫০ বছরের পুরনো স্থাপনা। এরচেয়ে পুরনো কোনো স্থাপনা ভোলার ইতিহাসে নেই। জেলা তথ্য বাতায়নেও ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি বিভাগে এ ধরনের কোনোকিছুর উল্লেখ নেই। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এ পুরাকীর্তি দেখতে আসছেন। ছবি তুলছেন। তৎকালীন সময়ের নির্মাণশৈলী দেখে সবাই অবাক হচ্ছেন। এমনকি প্রকৌশলীরাও এর নির্মাণশৈলী দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। প্রত্নতত্ত্ব বা পুরাকীর্তি যাদের আকৃষ্ট করে, নিঃসন্দেহে এ স্থাপনা তাদের নিরাশ করবে না। বিভিন্ন পেশাজীবী মহল সরকারিভাবে এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।
ওই স্থাপনার বর্তমান মালিক এবং স্থানীয়রাও এর পূর্ব ইতিহাস জানেন না। গত দেড়শ বছরের ইতিহাসে ওই স্থাপনার মালিকানা সিএস, আরএস, এসএ খতিয়ানে বর্তমান মালিকানা পূর্বপুরুষদের নামে বলে ওই ঘরে বসবাসরতরা জানান। ধারণা করা হয় রায়তি সূত্রে ওই প্রাসাদের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে।
বরিশাল বিভাগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৫৫০ বছর আগে চন্দ্রদ্বীপের (বর্তমান পটুয়াখালীর অংশ) রাজা জয়দেবের ছোট মেয়ে বিদ্যা সুন্দরী ও জামাতা গুড়িন্দার জন্য ওই রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। রাজার জামাতা গুড়িন্দা রাজসভার মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী গুড়িন্দা ১৪৭৫ সালের দিকে বিদ্যা সুন্দরীর নামে বিশাল দীঘি খনন করেন। এলাকায় বিদ্যা সুন্দরীর দীঘি নিয়েও নানা কল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। (সূত্র-বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, সিরাজউদ্দীন আমেদ)।
তবে প্রফেসর মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরীর ভোলা জেলার ইতিহাস ও এবিএম আমিনউল্যাহ বোরহানউদ্দিন থানার ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা জয়দেব তাঁর মেয়ে বিদ্যা সুন্দরীকে তারই রাজ্যসভার গোয়েন্দা প্রধানের সাথে বিয়ে দেন। তার মেয়ে ও জামাতার জন্য ওই রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করেন। রাজার জামাতা গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করার কারণে ওই বাড়ির নাম এক সময় গোয়েন্দা বাড়ি ছিল। ধারণা করা হয়, জমিদারি প্রথার পর কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে ওই বাড়ির নাম গুড়িন্দা বাড়ি হয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির দক্ষিণ ভিটায় স্থাপত্যের অবস্থান। সামনের অংশে নানা ধরনের নকশা করা। অনেক অংশ দিয়ে পলেস্তরা খসে গেছে। অযত্নে ভাঁজে ভাঁজে শ্যাওলা পড়ে আছে। প্রবেশ দুয়ার একটি। তবে আয়তন উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দুয়ারের প্রস্থ তিন ফুট আর উচ্চতা মাত্র পৌনে ৬ ফুট। ভেতরের দেয়ালে বিভিন্ন নকশা, আল্পনা। বারান্দা থেকে ভিতরের ঘরের দুটি দরজা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওই দরজা দুটির উচ্চতা মাত্র সাড়ে চার ফুট। দেয়াল এবং ছাদে চুন-সুড়কি ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়ালের প্রস্থ কমপক্ষে ২৫ ইঞ্চি। ছাদের প্রস্থও ১০-১১ ইঞ্চি। তবে মেঝে ক্ষয়ে গেছে। পশ্চিম দিক দিয়ে ইট-সুড়কির সিঁড়ি সরাসরি ছদের সাথে মিশেছে। ভবনের পেছনের দিকে মাটির সাথে ২-৩টি সুরঙ্গ মুখ। সিঁড়িতে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে তা দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি ও প্রস্থে ৬ ইঞ্চি। যে কয়টা ইট দেখা যায় সম্পূর্ণ অবিকৃত। ভেতর-বােইরে সব দিকের নির্মাণশৈলী দেখলে ৫৫০ বছর আগে কিভাবে এ কাজ করা সম্ভব হয়েছে তা এক বিস্ময়ের জন্ম দেবে।
ওই ঘরের বাসিন্দা আ. লতিফ জানান, এক সময় তার দাদা আ. আজিজ, দাদার ভাই দেলোয়ার হোসেন ও ফজলে করিম একসাথে থাকতেন। তাদের মৃত্যুর পর তার বাবা আ. কাদের ও পরবর্তী ওয়ারিশগণও বসবাস করতেন। এখন স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে তিনি বাড়ির পাশে ঘর করেছেন। এখন দেলোয়ার হোসেনের নাতি ৬২ বছর বয়সী নান্নু গুড়িন্দা ওই ঘরে থাকেন। নান্নু গুড়িন্দা ও আ. লতিফ গুড়িন্দা জানান, সরকারিভাবে ঘর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
সরেজমিনে গিয়ে বোরহানউদ্দিন পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী আ. সাত্তার ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মেহেদী হাসান জানান, ওই সময়ে এ ধরনের স্থাপত্য নির্মাণ সত্যিই বিস্ময়কর। আর এত বছর টিকে থাকার পর বর্তমান অবস্থায় থাকা আলো বিস্ময়কর।
বোরহানউদ্দিন থানার ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা এবিএম আমিনউল্যাহ্ জানান, আমি এক সময় প্রাচীন এ স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্য অনেক কাজ করেছি। এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখনও সময় আছে। এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণের উদ্যোগের দাবি জানাই।
সাঁচরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন মো. মহিবুল্যাহ মৃধা জানান, আমাদের গৌরবের ইতিহাসের সাক্ষী এ স্থাপনাকে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা সময়ের দাবি।
প্রবীণ সাংবাদিক ও সমাজকর্মী ওমর ফারুক তারেক জানান, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ স্থাপনা একটি জ্বলন্ত দলিল। অবিলম্বে এটা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাইফুর রহমান জানান, অবিলম্বে ওই প্রাচীন স্থাপনা পরিদর্শনপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।