স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি আলী আহামদের
প্রকাশিত: ৫-৬-২০২১ দুপুর ১২:২৫
আর কত অপক্ষোর প্রহর গুনতে হবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আহামদের পরিবারের? স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে অদ্যাবধি তার সহযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিসহ সম্মান পেলেও তিনি রয়েছেন বঞ্চিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যখন একের পর এক মুক্তিযোদ্ধারা নতুনভাবে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছেন, ঠিক তখনও তিনি কোন কারণে বঞ্চিত তা জানেন না আলী আহামদের পরিবার। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যতটুকু প্রমাণ থাকলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া যায়, তার সম্পূর্ণটাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর পরও কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তার চোখের সামনে দিয়ে পটিয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেকেই। অথচ ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদার, রাজাকার, আলবদর বাহিনীদের মূর্তিমান আতংক আলী আহমদ বারবার হচ্ছেন বঞ্চিত। ফলে আলী আহামদের রেখে যাওয়া সন্তানদের প্রশ্ন- আমার বাবার কি প্রাপ্য সম্মানটুকু পাব না?
তার পুরো নাম আলী আহমদ। তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মৃত হামিদ আলীর সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সাময়িক সনদ, বেসামরিক গেজেটে তথ্য থাকা সত্ত্বেও মেলেনি এ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মানটুকুও। এ নিয়ে সবার মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা যায়, উপজেলাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় পটিয়ার হাইদগাঁও ইউনিয়নে ১১নং ক্রমিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলী আহামমের নাম রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ১নং সেক্টরে অংশগ্রহণ করেন তিনি, যার সনদ নং: ম-৭৮৮৫৩। স্মারক নং মু.বি.ম/সা/চট্টগ্রাম, প্র:৩/১৮/২০০২/২১৫১ তারিখ ০৭/০৩/২০০৫ ইংরেজি। লাল মুক্তিবার্তার ক্রমিক নং-২০২০৪০১৮৪, গেজেটের পৃষ্টা ও তারিখ ১০২৮৭, নভেম্বর ২২, ২০০৫। গেজেট নং-২৮৫১। তার জন্ম তারিখ ০৪/০৩/১৯৪৩ইং। স্মরণিকা-৭১-এর ক্রমিক নং ১৮৪-এ আলী আহামমের নাম আছে। এছাড়াও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলী আহামদের নাম রয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর তিনি পাক হানাদার বাহিনীদের হাতে শহীদ হন। সবকিছু থাকার পরও কোনো লাভ হয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সকল ডকুমেন্ট পৌঁছে দেয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি আলী আহামদের। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো ধরনের সুবিধা পায়নি তার পরিবার। মুক্তিযোদ্ধা আলী আহামদ তার জীবনদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। তার স্ত্রী শহরবানু গত তিন বছর আগে তার স্বামী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বীকৃতি না পাওয়ার শোক-কষ্টে মারা যান। বর্তমানে তার রেখে যাওয়া সন্তানরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ভাঙ্গা বেড়ার ছোট্ট একটি ঘরে বসবাস করেন তার সন্তানরা।
জানা যায়, আলী আহামদের এক স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়ে। ১০ বছর পূর্বে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আহামদের স্ত্রী মারা যান। বর্তমানে বড় ছেলে শামশুল আলম কৃষিকাজ করেন, নুরুল আলম পানের দোকান করেন, মাহবুবুল আলম বনের কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করেন আর ছোট ছেলে আবু আলম মজুরের কাজ করছেন। ছোট মেয়ে ছেনোয়ারা বেগমকে একই এলাকায় বিয়ে দেন। আলী আহামদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত চেলে-মেয়েরা। ফলে পরিবারটি আজ অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছে। শুধুমাত্র জাতীয় দিবসগুলোতে সংবর্ধনা নিয়েই তাদের শান্ত থাকতে হয়।
কথা হয় ছোট ছেলে আবু আলমের সাথে। তিনি বলেন, আমার বাবা পটিয়া উপজেলার তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ ক ম শামসুজ্জমান চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহন করে ভারত সীমান্তের নাপাতন নামক স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে নিহত হন। আমরা সকল দপ্তরে কাগজপত্রগুলো জমা দিয়েছি। আমাদের ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন চৌধুরীর কাছে বারবার ধরনা দেই। তিনি আমাদের থেকে টাকা দাবি করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আহামদের পরিবার হিসেবে হাইদগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন খালেদ বাবুলসহ নেতৃবৃন্দ ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় দিবসগুলোতে তার স্ত্রী শহর বানুকে হাইদগাঁও স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্মাননাসহ নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় পটিয়ার এমপি হুইপ সামশুল হক চৌধুরী সরকারি অর্থায়নে উপজেলা পরিষদসংলগ্ন নির্মিত স্মৃতিসৌধের নামফলকেও দেখা যায় শহীদ আলী আহামদের নাম।
৫ বছর পূর্বে হাইদগাঁও মাইজপাড়ায় একটি অনুষ্ঠানে গেলে ওই সময় স্থানীয় এলাকাবাসী শহীদ আলী আহামদের বিষয়টি জানালে মাইজপাড়া আইয়ুব আলীর সড়কটির নাম পরিবর্তন করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আহামদের নামে নামকরণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এ নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব সরকার হলেও একটি কুচক্রী মহলের তৎপরতায় তার পরিবারের সদস্যরা সরকারি সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান।
বড় ছেলে শামশুল আলম ক্ষোভের সাথে জানান, ১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার টানে ৭ই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার পর নানান বাধা পায়ে ঠেলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমার বাবা যুদ্ধে চলে যান। আমার বাবার যৌবনের সবটুকু দিয়ে যুদ্ধ করেছেন স্বাধীনতার জন্য। তখন জীবনের মায়া ছিল আমার বাবার কাছে নগণ্য। আজ সেই আমার বাবা সবার কাছে নগণ্য হয়ে পড়েছেন। আমরা খেয়ে না খেয়ে একটি ভাঙ্গা ছোট্ট ঘরে বাস করছি। ঘরটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। টাকার অভাবে ভাঙ্গা ঘর মেরামত করতে পারছি না। আমরা মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান হিসেবে সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি- আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যেন স্বীকৃতি পান।
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কিবরিয়া বাবুলের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আলী আহামদ একজন প্রকৃত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু অদৃশ্য কোন কারণে তার পরিবার সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত তা আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আহামদের মুক্তিযোদ্ধা চলাকালীন গ্রুপ কমান্ডার পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম শামসুজ্জমান চৌধুরী সকালের সময়কে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আলী আহামদ আমার গ্রুপে থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি শহীদ হন। তবে কোন কারণে আলী আহামদ স্বীকৃতি পাননি তা আমি ঠিক জানি না।