রসায়ন ছাত্র থেকে বৈশ্বিক পর্যটন নেতৃত্বে আল মামুন

news paper

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১-১১-২০২৫ দুপুর ২:২

453Views

পর্যটকদের লাগেজ বহন করা থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য তুরস্ক ট্যুর ব্র্যান্ডের নেতৃত্ব মো. আল মামুনের গল্প অধ্যবসায়, সাহস ও দূরদর্শিতার এক অসাধারণ উদাহরণ। ২০০৮ সালে রসায়নে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মামুন বাংলাদেশ থেকে তুরস্কে পাড়ি জমান। তার একাডেমিক যাত্রা শুরু হয় ইজমির শহরে। তৃতীয় বর্ষে তিনি ইস্তানবুলে চলে আসেন, আর সেখানেই নিঃশব্দে শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়।

পড়াশোনার পাশাপাশি মামুন খণ্ডকালীনভাবে পর্যটন খাতে কাজ শুরু করেন। প্রথম কাজ ছিল হোটেল ও বিমানবন্দরে ট্রলি বয় হিসেবে ভ্রমণকারীদের লাগেজ বহন করা। কাজটি ছিল কষ্টকর, কিন্তু এখান থেকেই তিনি শিখেছিলেন পর্যটন শিল্পের প্রকৃত চিত্র।

স্মৃতিচারণা করে মামুন বলেন, ‘আমি দেখতাম, তুরস্কে এসে মানুষ কতটা আনন্দিত হয়। তখনই স্বপ্ন দেখেছিলাম, একদিন আমিও মানুষকে এই দেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সাহায্য করব।’

শিক্ষা সম্পন্ন করার পর মামুন সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ ও তুরস্কের পর্যটন খাতের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করবেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি ভ্রমণ সংস্থা, যা বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য তুরস্ক ট্যুর প্যাকেজ এবং দেশীয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর জন্য সহায়তা প্রদান করে। তবে শুরুর পথ ছিল কঠিন।

তিনি বলেন, ‘প্রথম বছর আমি বাংলাদেশের বহু ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়েছিলাম। অনেকে বিশ্বাস করত না, কেউ সহযোগিতাও করত না। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।’

সবকিছু বদলে যায় যখন তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি ট্রাভেল ফেয়ারের খবর পান। সাহস করে তিনি একটি স্টল বুক করেন নিজের কোম্পানি ও তুরস্ক ট্যুর প্রচারের জন্য। বিশ্বাস অর্জনের লক্ষ্যে তার তুর্কি ব্যবসায়িক অংশীদারকেও আমন্ত্রণ জানান মেলায় অংশ নিতে।

মামুন বলেন, ‘যখন মানুষ দেখল আমাদের স্টলে তুর্কি প্রতিনিধিরা উপস্থিত, তখন তাদের আগ্রহ বেড়ে যায়। সেই ট্রাভেল ফেয়ারই ছিল আমার ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।’

মেলার পর মামুন ও তার অংশীদার এক মাস ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি পরিদর্শন করেন, তাদের সেবা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন এবং সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই কয়েকটি এজেন্সি তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করে।

অংশীদার তুরস্কে ফিরে গেলেও মামুন থেকে যান বাংলাদেশে। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই বাজারে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। পরবর্তী দুই বছর তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, দল গঠন করেন, বন্ধুদের প্রশিক্ষণ দেন এবং ধীরে ধীরে সাফল্যের মুখ দেখেন।

বর্তমানে মামুনের প্রতিষ্ঠানটি একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে তিনি ৫৬ সদস্যের একটি দল পরিচালনা করেন, যাদের সহায়তা করছে ইস্তানবুলের ৮ সদস্যের অপারেশন টিম। তুরস্কে রয়েছে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়, আর বাংলাদেশের গাজীপুরে আঞ্চলিক অফিস।

এখন পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশি বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সি তাদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে কাজ করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়— ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মাল্টা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিপাইনের মতো ৩৫টিরও বেশি দেশের ট্রাভেল এজেন্সি মামুনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তুরস্কে ক্লায়েন্ট পাঠাচ্ছে।

ডিজিটাল মার্কেটিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচারণা ও সেলিব্রিটি স্পনসরশিপের মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠানটি এখন অন্যতম পরিচিত তুরস্ক ট্যুর ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ৮০ হাজার এরও বেশি পর্যটক তাদের মাধ্যমে তুরস্ক ভ্রমণ করেছেন, সবাই পেয়েছেন পেশাদার সেবা ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

মামুন বলেন, ‘আমাদের পথ সহজ ছিল না। কিন্তু প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আমাদের আরও শক্ত করেছে। আমরা প্রমাণ করেছি— বিশ্বাস, দলগত কাজ ও মানসম্মত সেবাই গ্লোবাল সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।’

অবিরাম সাফল্যের মাঝেও মামুন তার লক্ষ্য নিয়ে স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি চাই আমার প্রতিষ্ঠান তুরস্কের সেরা ট্যুর অপারেটর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক; এমন একটি ব্র্যান্ড, যা বিশ্বাস, উৎকর্ষতা ও অনন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতার প্রতীক হবে।’

রসায়ন ছাত্র থেকে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের নেতৃত্বে পৌঁছে যাওয়া মো. আল মামুনের গল্প তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস যা প্রমাণ করে, সততা, নিষ্ঠা ও নিজের স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়।


আরও পড়ুন