মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা সংকট থেকে প্রযুক্তি বাজার: বাংলাদেশের করণীয় কি?
প্রকাশিত: ৮-৯-২০২৫ সকাল ৯:৫৯
বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার—এই শ্রমবাজারগুলোই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রবাসী আয় এখনো জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশের বেশি জোগান দেয়। এই রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহই করে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখে।
কিন্তু গত এক দশকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) ভিসা ইস্যুতে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য শুধু শ্রমবাজার সংকোচনের নয়, বরং একটি নতুন ধরণের কৌশলগত চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। বাংলাদেশ একদিকে হারাচ্ছে শ্রমবাজারের সুযোগ, অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী খাতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও ফসকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মসংস্থানকারী প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বাংলাদেশি কর্মীদের সংখ্যা ২০২৩ সালে প্রায় ১ লাখের কাছাকাছি ছিল, যা ২০২৪ সালে প্রায় ৪৭,০০০–এ নামিয়ে এসেছে—প্রায় ৫০ % হ্রাস ঘটেছে । এই পতনের পেছনে মূল কারণ হলো ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতা, অভিবাসন ব্যবস্থা এবং দক্ষতা বিষয়ক চ্যালেঞ্জ—যা শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল করে দিয়েছে।
অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন এবং এমনকি নেপালের মতো দেশগুলো ইউএই-র শ্রমবাজারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-এর রিপোর্ট বলছে, ইউএই-তে ভারতীয় প্রবাসীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ, পাকিস্তানি ১২ লাখ এবং ফিলিপাইন থেকে প্রায় ৭ লাখ। অথচ বাংলাদেশের সংখ্যা এখনো তুলনামূলকভাবে স্থবির এবং সীমিত।
এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্সে। বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে সৌদি আরব, আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্যের অবদান যেখানে বাড়ছে, সেখানে ইউএই থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্সের হার কমতির দিকে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ে একটি বড় ধরণের চাপ তৈরি হবে।
ইউএই কেবল শ্রমবাজার নয়, বরং আজকের দিনে একটি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের বৈশ্বিক হাব। দুবাই, আবুধাবি কিংবা শারজাহ এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ব্লকচেইন, ফিনটেক, সবুজ জ্বালানি, মহাকাশ গবেষণা ও স্মার্ট সিটির জন্য বিশ্বমানের কেন্দ্র।
দুবাই ইন্টারনেট সিটি এবং দুবাই সিলিকন ওএসিস ইতোমধ্যে বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। ভারতীয় আইটি কোম্পানি ইনফোসিস, উইপ্রো এবং টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস এসব খাতে কার্যকরভাবে যুক্ত হয়েছে। মিশর ও ফিলিপাইনও কল-সেন্টার এবং আউটসোর্সিং খাতে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। সফটওয়্যার ও আইটি খাতে আমাদের সক্ষমতা থাকলেও, সেই সক্ষমতাকে কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে বাজারজাত করার কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (BASIS)-এর তথ্যমতে, দেশের আইটি খাত প্রতিবছর প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু সেই বাজারের বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানে সীমাবদ্ধ। ইউএই কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের প্রযুক্তি বাজারে বাংলাদেশ কার্যত অদৃশ্য।
এখানে আমাদের অন্যতম বড় ব্যর্থতা হলো অর্থনৈতিক কূটনীতির অদূরদর্শিতা। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো এখনো মূলত শ্রমবাজার রক্ষা ও ভিসা প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করা, যৌথ গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেওয়া, বা উদ্ভাবনী খাতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ভারত এই জায়গায় ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। তারা একদিকে শ্রমবাজার সুরক্ষিত করেছে, অন্যদিকে উচ্চপ্রযুক্তি ও শিক্ষাখাতেও নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। আজকে দুবাইয়ের কোনো বড় প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে ভারতীয় কোম্পানির অংশগ্রহণ দৃশ্যমান, কিন্তু বাংলাদেশের উপস্থিতি খুবই নগণ্য।
বাংলাদেশের জন্য এ দ্বৈত সংকটের অর্থ দাঁড়াচ্ছে—
(১) রেমিট্যান্স আয় কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আরও প্রকট হবে; (২) প্রযুক্তি বাজারে কার্যকর উপস্থিতি না থাকায় আমরা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির মূলধারায় প্রবেশ থেকে পিছিয়ে পড়ব; (৩) প্রতিযোগী দেশগুলো—ভারত, ফিলিপাইন ও মিশর—শুধু শ্রমবাজারেই নয়, প্রযুক্তি বাজারেও নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে; (৪) দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ কেবল ‘লো-স্কিলড লেবার এক্সপোর্টার’ হিসেবেই পরিচিত হবে, যা আমাদের বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ইমেজকে দুর্বল করে দেবে।
তাহলে প্রশ্ন আসে—এই দ্বৈত সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী? শ্রম ও প্রযুক্তি উভয় খাতেই সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া এখন অপরিহার্য। বিশ্লেষকদের মতে—(১) শ্রমবাজারের পাশাপাশি প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ খাতেও বাংলাদেশি দূতাবাস ও কনস্যুলেটকে আরও সক্রিয় করতে হবে;
(২) প্রবাসী কর্মীদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করে ভিসা–সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে হবে, পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতে নতুন দক্ষতা উন্নয়নে সরকার–বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে;
(৩) বাংলাদেশি স্টার্টআপ ও আইটি কোম্পানিকে ইউএই–র ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও ইনোভেশন হাবের সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে;
(৪) ইউএই বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও যৌথ গবেষণা প্রকল্পে বাংলাদেশি তরুণদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে;
(৫) এবং সর্বোপরি, শুধু শ্রম রপ্তানি নয়—প্রযুক্তি সেবা, আউটসোর্সিং ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কার্যকর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা জটিলতা আজ বাংলাদেশের জন্য কেবল প্রবাসী শ্রমবাজার সংকোচনের সতর্ক সংকেত নয়; এটি বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার এক সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। শ্রম ও প্রযুক্তি—দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সুযোগ হারাচ্ছে ভারতের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের কাছে।
যদি এখনই কৌশলগত অর্থনৈতিক কূটনীতি গ্রহণ না করা যায়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সীমিত রেমিট্যান্সনির্ভর ও নিম্নপ্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। তখন উন্নত অর্থনীতির স্বপ্ন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—বিদ্যমান শ্রমশক্তিকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি বাজারে বাংলাদেশকে দৃশ্যমান ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা। নচেৎ, সুযোগ চলে যাবে অন্যদের হাতে এবং হারিয়ে যাবে আগামী প্রজন্মের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ।
মোহাম্মদ আনোয়ার
মানবাধিকার ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক