আ-তে আলো, আ-তে আধাঁর

news paper

এসএম পিন্টু

প্রকাশিত: ৭-৯-২০২৫ দুপুর ১:৩৮

306Views

“আ-তে আলো, আ-তে আধাঁর” এই বাক্যটি কেবল বাংলা ভাষার অক্ষর দিয়ে খেলা নয়, বরং মানবজীবনের এক গভীর দর্শন। আমাদের প্রত্যেকের জীবন হলো আলো-আধাঁরের মিশ্রণে গড়া। কখনো আলোর জয়, কখনো আধাঁরের আধিপত্য এই দ্বন্দ্বেই জীবন এগিয়ে চলে।
”আ” হচ্ছে বাংলা বর্ণমালার একটি অক্ষর। এই অক্ষর দিয়ে গঠিত অসংখ্য শব্দ আমাদের জীবন, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, একই অক্ষরে শুরু হয় দুটি বিপরীতার্থক শব্দ “আলো” ও “আধাঁর”। মানুষের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই আলো আর আধাঁরের উপস্থিতি আছে। আলো মানে শুধু সূর্যের আলো নয়, বরং জ্ঞান, মুক্তি, প্রেম, মানবতা, সৌন্দর্য ও সত্যের প্রতীক। আধাঁর মানে কেবল রাতের অন্ধকার নয়, বরং অজ্ঞতা, ভয়, মিথ্যা, অবিচার ও অশুভ শক্তির প্রতীক। এই দ্বৈততাই মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি। আমরা কখনো আলোয় ভাসি, কখনো অন্ধকারে হারাই। সাহিত্য, দর্শন, সমাজ, রাজনীতি, এমনকি আমাদের অন্তর্দশনেও আলো-আধাঁরের এই দ্বন্দ্ব বারবার ফিরে আসে। তাই “আ-তে আলো, আ-তে আধাঁর” কেবল শব্দের মিল নয়; এটি মানবজীবনের অনিবার্য সত্য। মানুষ ইচ্ছে করলে আধাঁরকে আলোতে পরিনত করতে পারে। আবার সেই একই মানুষের দায়িত্ব জ্ঞানহীন কর্মকান্ডে সব আলো হারিয়ে যায় আধাঁরের গহীনে। মানুষের জীবন যাতে আলোয় ভরে থাকে সবসময় সেই চিন্তা থেকে আমি এই বিষয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। 

আলো ও আধাঁরের প্রতীকী ব্যাখ্যা: 
আলো মানে সত্য, শুভ ও সুন্দরের মিশ্রণে তৈরি সফলতা। মানুষ চিরকাল আলো খুঁজেছে। এই আলো শুধুমাত্র সুর্যের বা বিদ্যুতের আলোই নয়, এটা জ্ঞানের আলোকে বুঝায়। সমাজের অশুভ শক্তির পরাজয় ও শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখাকে বুঝায়। আলো জন্ম দেয়, আলো শেখায় কিভাবে নিজেকে টিকিয়ে রেখে অন্যকেও রক্ষা করা যায়। 
অন্যদিকে, আধাঁর মানে অশুভ, ভয়, দুঃখ, ব্যর্থতা, সামাজের অশান্তি, মৃত্যুর ছায়া। তবে আধাঁর ছাড়া আলোও অর্থহীন। যেমন, রাত না থাকলে দিনের মূল্য বোঝা যেত না, তেমনি দুঃখ না থাকলে সুখকেও অনুভব করা যেত না।
আধাঁরকে সবসময় নেতিবাচকভাবে দেখা হয়, কিন্তু এরও প্রয়োজন আছে। আধাঁর মানুষকে চিন্তাশীল করে তোলে, মানুষকে আলো খুঁজতে শেখায়। তাই আলো-আধাঁরের দ্বন্দ্বই মানুষকে পরিপূর্ণ করে তোলে।

আলো জীবনের দিশারি:

১.১ আলো ও জীবনের সম্পর্ক:

আলো ছাড়া পৃথিবী অচল। সূর্যের আলো না থাকলে উদ্ভিদ জন্মাত না, প্রাণী টিকে থাকত না, আর মানুষ সভ্যতা গড়তে পারত না। প্রকৃতির প্রতিটি স্রোতধারা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে জীবনকে নবজাগরণ দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় আলো এক ধরনের শক্তি, কিন্তু মানবিক ভাষায় আলো মানে আশা, দিশা ও উজ্জ্বলতা। সুর্যের আলোর পাশাপাশি জ্ঞানের আলো না থাকলে সুন্দর সমাজ বা রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়।

১.২ জ্ঞান ও বিজ্ঞানে আলো আধাঁর:
বিজ্ঞান মানুষের জীবনে আলো এনেছে। বিদ্যুতের আবিষ্কার, ওষুধ, প্রযুক্তি সবই আলোর প্রতীক। প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনে যেমন অনেক উপকারী তেমনি প্রযুক্তির অপব্যবহার আধাঁর সৃষ্টি করে। যেমন, পারমাণবিক শক্তি বিদ্যুৎও দিতে পারে, আবার ধ্বংসও আনতে পারে। ইন্টারনেট জ্ঞান ছড়াচ্ছে (আলো), আবার ভুয়া খবর অপরাধও বাড়াচ্ছে (আধাঁর)। আবার ফেইসবুক, টিকটক, ইউটিউবের ব্যবহার একদিকে মানুষের উপকারে লাগলেও অন্যদিকে এর অপব্যবহারের ফলে অনেকের পরিবারেই নেমে আসে আধাঁরের কালো ছায়া।  তথা কথিত প্রেমের নামে নোংরামি, বিচ্ছেদ জীবন যাপনে আমুল পরিবর্তণ, লেখা পড়ায় অমনোযোগী। পরকীয়ার বলীতে সংসার ভেঙে যাচ্ছে। এসবের নেশায় পড়ে প্রয়োজনীয় কাজে অমনযোগী হওয়ার ফলে কাজে ব্যঘাত ঘটা, অনেকের চাকরী চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনলাইনে গেইম চর্চার ফলে আধাঁরের পথে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক তরুণ তরুণীর জীবন। আবার অনেককে দেখা যায় অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিন কাটাতে। অনেক ভালো ভালো পরিবার তছনছ হয়ে গেছে।

আলো জ্ঞানের প্রতীক। যে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে, সে অন্ধকার থেকে মুক্তি পায়। যারা প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতে পেরেছে তারাই সফল হয়েছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগকে বলা হয় “এজ অফ এনলাইটেনমেন্ট” অর্থাৎ আলোকিত যুগ। এ সময় মানুষ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছিল। 

১.৩ সাহিত্য ও কবিতায় আলো:
বাংলা সাহিত্যে আলো এক অনন্ত অনুপ্রেরণা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন আলোকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গান ও কবিতা। নজরুলের কবিতায় আলো মানে বিদ্রোহ, জাগরণ, দুঃখ ভাঙার শক্তি। জীবনানন্দ দাশও আলো-অন্ধকারের খেলা দিয়ে তার কাব্য জগতকে রহস্যময় করে তুলেছেন।

১.৪ আধ্যাত্মিক আলো:
ধর্ম-দর্শনে আলোকে বলা হয় সত্যের প্রতীক। ইসলাম ধর্মে আল্লাহকে বলা হয়েছে “নূর” (আলো)। কুরআনে আলোকপ্রাপ্তি মানে হিদায়াত, আর অন্ধকার মানে গোমরাহি। হিন্দু ধর্মে আলো মানে সত্য ও জ্ঞান। দীপাবলি হলো আলো দিয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ। বৌদ্ধধর্মে জ্ঞানপ্রাপ্তি মানে আলোর দিকে যাত্রা। অজ্ঞানতা ও আসক্তি হলো অন্ধকার। খ্রিস্টধর্মে যিশুকে বলা হয়েছে ”লাইট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”  অর্থাৎ বিশ্বের আলো। তাই আলো শুধু ভৌত নয়, আধ্যাত্মিকও বটে। দর্শনে আলো-আধাঁর একে অপরকে ছাড়াই অসম্পূর্ণ। এরা একে অপরকে পরিপূর্ণ করে।
যেখানে আলো নেই, সেখানেই আধাঁর। অন্ধকার কেবল ভৌত পরিবেশ নয়, এটি মানসিক অবস্থা। ভয়, অজ্ঞতা, অনিশ্চয়তা সবই আধাঁরের প্রতীক।

সাহিত্য ও শিল্পে আলো আধাঁর:
আলো আধাঁরের খেলা সাহিত্যকে করেছে রহস্যময়। শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডিতে অন্ধকার মানে ষড়যন্ত্র, মৃত্যু আর ভয়ের প্রতীক। বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে আধাঁর মানে সমাজের কুসংস্কার দুঃখ, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবিচারকে বুঝানো হয়েছে। আর মানবিক প্রেম-দয়া-সহমর্মিতা হলো আলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: তাঁর কবিতা ও গানে আলোকে সত্য ও জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। যেমন আলো মানে শিক্ষা, আধাঁর মানে অজ্ঞতা। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন, আলো হলো মুক্তির ডাক, আধাঁর হলো দাসত্ব ও অন্যায়ের প্রতীক। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় আলো-আধাঁর মানুষ ও প্রকৃতির ভেতরের দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করেছেন।

মানসিকতার প্রতীক:
আধাঁর মানুষের ভেতরের হতাশা, শূন্যতা, একাকিত্বের প্রতিচ্ছবি। অবসাদগ্রস্ত মানুষকে আমরা বলি “অন্ধকারে ডুবে আছে।” তাই আধাঁর কেবল বাহ্যিক নয়, অভ্যন্তরীণও।

জীবনের পরীক্ষায় অন্ধকার:

মানুষ জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়। কখনো সফলতা আলো হয়ে আসে, কখনো ব্যর্থতা অন্ধকার নামিয়ে আনে। কিন্তু আধাঁরের অভিজ্ঞতাই মানুষকে শক্ত করে।

আলো ও আধাঁরের দ্বন্দ্ব:
মানবসভ্যতার ইতিহাস আসলে আলোকিত সময় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের পালাবদল। একদিকে মধ্যযুগের অন্ধকার, অন্যদিকে রেনেসাঁর আলোকিত জাগরণ। একদিকে ঔপনিবেশিক শোষণ, অন্যদিকে মুক্তির আলো।
একজন দুর্নীতিবাজ শাসকের যুগ হলো আধাঁরের যুগ। আর একজন সৎ নেতার যুগ হলো আলোকিত যুগ। যেমন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি স্বাধীনতার আলো পেয়েছিল, অথচ পাকিস্তানি শাসনের সময় ছিল দমবন্ধ অন্ধকার।

আধাঁর ছাড়া সংস্কৃতি ও শিল্পকর্মে গভীরতা আসে না। চিত্রকলায় ‘শেড অ্যান্ড লাইট’-এর খেলাই শিল্পকে সৌন্দর্য দেয়। একইভাবে সাহিত্যেও আলো-আধাঁরের মিলনে সৃষ্টি হয় নাটকীয়তা।

 

আলো আধাঁরে জীবন:
যদি পৃথিবীতে কেবল আলো থাকত, তবে চোখ ঝলসে যেত, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেত। রাত না থাকলে মানুষ বিশ্রাম পেত না। তাই আলো একা জীবনকে সম্পূর্ণ করতে পারে না। আবার যদি কেবল অন্ধকার থাকত, তবে মানুষ পথ চিনতে পারত না, সভ্যতা গড়ে উঠত না, জ্ঞান বিস্তার লাভ করত না। তাই কেবল আধাঁরও মানবতার জন্য ধ্বংস ডেকে আনত। 
তবে জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে হলে আলো আধাঁরের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলবে আলো-আধাঁরের মিশ্রণ। যেমন আনন্দকে উপলব্ধি করতে হলে দুঃখের স্বাদ নিতে হয়, তেমনি আলোকে বুঝতে হলে অন্ধকারে থাকতে হয়।
আলো-আধাঁরের শিক্ষণীয় দিক:

আলো শেখায় এগিয়ে যেতে, আধাঁর শেখায় ধৈর্য ধরতে, আলো মানুষকে উজ্জ্বল করে, আধাঁর মানুষকে পরিণত করে। দু’য়ের সমন্বয়েই মানুষ পূর্ণতা লাভ করে। মানুষের জীবনে আলো মানে সুখ, আশা, সততা; আধাঁর মানে দুঃখ, হতাশা, প্রতারণা। প্রতিটি মানুষই জীবনে এই দুইয়ের লড়াই করে। ভালোবাসা হলো আলোর উৎস। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা বা বিরহ আধাঁরের জন্ম দেয়। জন্ম মানে আলো, মৃত্যু মানে আধাঁর। তবে মৃত্যু ছাড়া জীবনের পূর্ণতা নেই। তাই আলো-আধাঁর দুটোই প্রয়োজন।

উপসংহার:
“আ-তে আলো, আ-তে আধাঁর” এই ছোট্ট শব্দযুগল আসলে জীবনের মহাগ্রন্থ, মানব জীবনের সারাংশ। আলোকে বুঝতে হলে আধাঁরের প্রয়োজন, আবার আধাঁর কাটাতে হলে আলোর প্রয়োজন। আলো-অন্ধকার শুধু প্রকৃতির খেলা নয়, এটি মানুষের অন্তর্লোক, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আলো আমাদের স্বপ্ন দেখায়, আধাঁর আমাদের ধৈর্য শেখায়। জীবনে আলো-আধাঁরের মিলনেই সৃষ্টি হয় প্রকৃত সৌন্দর্যর্। আমাদের দায়িত্ব হলো জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে, বিজ্ঞানে আলোর জয় ঘটানো এবং আধাঁরের শক্তিকে পরাজিত করা। আধাঁর জীবনে দরকার হলেও বাস্তবিকপক্ষে আমরা আধাঁর দুর করে আলোর পথেই চলার চেষ্টা করব। তাহলে সমাজ দেশ সবখানেই শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হবে সারাজীবন।
লেখক: সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।


আরও পড়ুন