মোদির চীন সফর ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাব
প্রকাশিত: ৭-৯-২০২৫ দুপুর ১২:১৮
ভারত ও চীন বড় অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় চীন ও ভারতের অবস্থান যথাক্রমে দ্বিতীয় ও পঞ্চম। তবে আগামী বছরগুলোয় ভারতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপর থাকবে। ৪ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতি ও ৫ লাখ কোটি ডলারের শেয়ারবাজার নিয়ে ২০২৮ সাল নাগাদ ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস এমনটিই বলছে।বেইজিংভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উসাওয়া অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কিয়ান লিউ বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক। চিরাচরিতভাবে বিশ্ব যখন এই সম্পর্কের ওপর মনোযোগ দিয়েছে, তখন সময় এসেছে বিশ্বের দ্বিতীয় ও সম্ভাব্য তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত ও চীন কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তার ওপর মনোযোগ দেওয়ার। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর অতিরিক্ত বাণিজ্য শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দিল্লিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেই প্রসঙ্গ টেনে চীনের রাষ্ট্রদূত শু ফেইহং যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি নিশানা করেছেন। তিনি বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে মুক্ত বাণিজ্য থেকে ব্যাপক উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এখন বিভিন্ন দেশ থেকে অতিরিক্ত দাম আদায় করার জন্য দর কষাকষির মাধ্যম হিসেবে তারা শুল্ককে ব্যবহার করছে।' যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে, এমনকি তা আরও বাড়ানোর হুমকিও দিয়েছে, চীন কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করে। এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের সামনে চুপ করে থাকলে যারা দাদাগিরি চালায় তারা সাহস পায়। বিশ্ব বাণিজ্যের সঙ্গে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে চীন দৃঢ়ভাবে ভারতের পাশে থাকবে।
এর আগে একই সুর শোনা গিয়েছিল চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কণ্ঠেও। ভারত সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, 'একতরফা তর্জন-গর্জন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মুক্ত বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। দ্বিতীয় দফায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একাধিক ইস্যু নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানা- পোড়েন দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের দিকে নজর রয়েছে বিশ্বের। প্রসঙ্গত, বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন লড়াই সম্প্রতি তুঙ্গে পৌঁছে যায় যখন ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর শুল্ক দিলে তারাও পাল্টা ব্যবস্থা নেয় এবং দুই দেশেরই পারস্পরিক শুল্ক তিন অঙ্কের ওপরে চলে যায়। পরে দুই পক্ষই আলোচনায় রাজি হয় এবং আগামী নভেম্বর পর্যন্ত সেই আলোচনা চলবে বলে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। চীন ও ভারত কিন্তু কিছু বিষয়ে সহমত। যেমন বৈশ্বিক স্তরে গ্লোবাল সাউথ সেইভাবে প্রতিনিধিত্ব পায় না-এই প্রসঙ্গে দুই দেশ একমত পোষণ করে। কিন্তু কিছু মৌলিক পার্থক্যও রয়েছে। তার মধ্যে একটা হলো চীনের (ভৌগোলিক) সম্প্রসারণের প্রবণতা।তাছাড়া ভারত-চীন গত কয়েক বছর ধরে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত বিবাদসহ অন্যান্য ইস্যুর সমাধান খুঁজেছে। সামরিক স্তরে বৈঠক হয়েছে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন, এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাবেন চীনে। সব কিছু ধাপে ধাপে হয়েছে। ট্রাম্পের কারণে রাতারাতি হয়নি। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষার বিষয়ে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সাউথ এশিয়ান পলিটিক্স অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ'-এর গবেষক উপমন্য বসু বলেছেন,'ভারত-চীনের মধ্যে স্থিতিশীলতা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষে হিতকর। কিন্তু আসন্ন বৈঠকে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কী আলোচনা হয়, কে কতটা নেগোশিয়েট করে এবং বিষয়গুলোর আরও রাজনীতিকরণ হবে কি না তার ওপর নির্ভর করছে পুরো ব্যাপারটা।'
তবে প্রতিবেশী হিসেবে ভারত- চীনের সম্পর্ক ভালো হওয়া উচিত। কিন্তু চীনকে ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং সীমান্তকে সম্মান জানাতে হবে। এই বিষয়গুলো সবসময় ভারতের মাথায় থাকবে। সবার আগে সীমান্তের বিষয়ে সমাধান দরকার। কিন্তু তারপরেও বিবাদিত এলাকা নিয়ে চীন চুপ করে বসে থাকবে বলে মনে হয় না। চীন ভারতের সাম্প্রতিক আলোচনায় দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিষয়, তীর্থযাত্রা, নদী বিষয়ক তথ্য ভাগ করে নেওয়া, সীমান্ত বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে কথা হয়েছে। সার, বিরল মাটি ও টানেল বোরিং মেশিন নিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে চীন। প্রসঙ্গত, সরকারি তথ্য অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে ২০২৪-২৫ সালে ১২৭.৭ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়েছে। সংঘাতের আবহেও কিন্তু বাণিজ্যের দিক থেকে ভারত বা চীন কেউ কাউকে উপেক্ষা করেনি। সম্প্রতি বিরল খনিজ, মেশিনারি ইত্যাদি নিয়ে কথা হয়েছে। কাজেই বাণিজ্যের দিক থেকে সম্পর্ক ভালো। কিন্তু ভূ-রাজনীতির কথা মাথায় রাখলে বিশ্বাসের অভাব বিষয়টা সব সময় রয়েছে।চীনের তরফে সাম্প্রতি বাঁধ ঘোষণা করা বা অরুণাচলের বেশ কয়েকটা জায়গার নাম বদলে ফেলার ঘটনা কিন্তু ভারতের চিন্তার কারণ থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক সমীকরণের আবহে ভারত,জাপান,অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের জোট 'কোয়াডে' প্রভাব পড়তে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। কোয়াডের অস্তিত্ব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের জন্য কোয়াড প্রভাবিত হবে বলে আমার মনে হয় না, কারণ সেখানে জাপানের মতো দেশও রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত দু'জনেই যে একে অপরকে উপেক্ষা করতে পারবে না। ট্রাম্পের পরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক থাকবে। তাই শত অসুবিধা সত্ত্বেও ভারতের কূটনৈতিক সংঘাত এড়িয় চলা দরকার। তবে এই মুহূর্তে ভারতের কাছে অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই।
ট্রাম্প প্রশাসন যাই বলুক যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ভারতকে এড়িয়ে চলা সম্ভব না। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কসহ একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে ভারতের মাল্টি অ্যালাইনমেন্ট পলিসি বা বহু-প্রান্তিক কূটনৈতিক কৌশল সমালোচিত হয়েছে। ভারতের বহু-প্রান্তিক কূটনৈতিক কৌশল স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। এই কৌশল ভারতকে সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কথা ছিল কিন্তু তা সবার কাছে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।কোন দেশ মাল্টি অ্যালাইনড নয়? ভারতের ডিপ্লোম্যাটিক ক্যাপিটাল রয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে ভারত রাশিয়া, চীনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারে। নিজেদের কৌশলগত স্বাতন্ত্র বজায় রাখার কারণে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারত ভাল সম্পর্ক রেখেছে। দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েই এই পদক্ষেপ নিয়েছে। মাল্টিপোলার বিশ্বে ভারত ব্রিক্স এবং কোয়াডের মতো একাধিক জোটে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ আসলে চীনকে সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যত তার কৌশলগত অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে এইভাবে দাদাগিরি দেখাবে, চীনের পক্ষে তারা বৈশ্বিকস্তরে ততই সুবিধা করে দেবে। আমার মনে হয় না ভারতের কাছে চীন কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে। তবে ভারত-চীন বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠবে সেটা বোধহয় সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বৈঠক প্রমাণ করে যে চীনও ভারতকে প্রিয় বন্ধু করার বিষয়ে আগ্রহী নয়।বৈশ্বিকস্তরে দুই দেশই পোক্ত খেলোয়াড়। একমাত্র সমাধান হতে পারে দুই দেশের পক্ষ থেকেই কৌশলগত ভারসাম্যকে রক্ষা করা। চীন ও ভারতের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারত্বের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি আরও ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের আগ্রহ দেখাতে পারে। আর দ্রুত ভারতের ভিসার অনুমোদন চীনের জন্য সহজ বিজয় হতে পারে। হয় সরাসরি, না হয় বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে চায় বেইজিং।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কে মন্দার কারণে এসিওর প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বুঝতে পেরেছে নয়াদিল্লি। একইভাবে ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক নিয়ে বিশৃঙ্খলার মধ্যে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর মধ্যে সংহতিকেও মূল্যায়ন করবে চীন। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকসও ট্রাম্পের রোষানলে পড়েছে। এই জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চীন, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। জোটের সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতা হয়েছে, তার ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সবশেষ ২০২৪ সালের অক্টোবরে রাশিয়া অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে শি চিন পিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন মোদি। আর গত সপ্তাহে রাশিয়ার দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলেছেন, চীন ও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করছে মস্কো ভারতের প্রায় দেড় শ কোটির মানুষের কাছে নিজেদের পণ্য বিক্রির সুযোগকে স্বাগত জানাবে তারা। দুই দেশের সম্পর্কে যে জটিলতা রয়েছে, তাতে মোদি-শির একটি বৈঠকে হয়তো বড় পরিবর্তন আসবে না। নয়াদিল্লি-বেইজিং সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। তবে মোদির চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব মিটতে পারে। একই সঙ্গে এটি ওয়াশিংটনের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা যে ভারতের কাছে বিকল্প পথ আছে। রাশিয়া, চীন ও ভারত নিজেদের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে বলে মনে করেন চ্যাথাম হাউসের গবেষক চিয়েতিজ বাজপেয়ি এবং ইউ জি। তাঁরা বলেন, চীন তাদের উৎপাদনক্ষমতা, ভারত সেবা খাতের শক্তি ও রাশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে সম্মিলিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে। তাদের রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবাহের নতুন রূপ দিতে পারে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক