ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.): সৃষ্টির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ মহোৎসব
প্রকাশিত: ৫-৯-২০২৫ বিকাল ৭:৫৯
জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণার ভিত্তিতে, এ বছর বাংলাদেশে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আগামীকাল, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ (শনিবার) উদযাপিত হবে। মধ্যপ্রাচ্যে এটি পালিত হবে একদিন আগে, অর্থাৎ আজ, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ (শুক্রবার)।
বিশ্বমানবের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির পয়গামসহ ৫৭০ সালে ১২ই রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার সুবহে সাদেকের সময় মহাবিশ্বে আগমন করলেন প্রিয় নবী, খাতামুন্নাবীঈন, রহমাতাল্লিল আলামীন, শান্তির অগ্রদূত ও মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত রহমত ও দয়া এই নবীর মাধ্যমে প্রবাহিত করছেন। সকল হামদ মহীয়ান স্রষ্টার জন্য, যিনি তাঁর বন্ধু রহমাতাল্লিল আলামীনকে সর্বোত্তম গুণাবলীর মাধ্যমে প্রেরণ করে গোটা বিশ্ববাসীকে ধন্য করেছেন, কুল কায়েনাতকে আলোকিত করেছেন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে মানবতার ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করেছেন।
পবিত্র ১২ই রবিউল আউয়াল বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের জন্য নিঃসন্দেহে রহমত ও বরকতময়। নবীজির আগমনের দিনে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আদব ও সম্মানের সাথে বিভিন্ন নাতে রাসূল, জশনে জুলুস, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর জন্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি স্মরণ করে, শানে রেসালাতের আদর্শ ও শিক্ষার আলোকে সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আনন্দ উদযাপন করেন। বর্তমান মুসলিম উম্মাহর সংকটময় অবস্থার উত্তরণ ও ইসলামের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান উপায় হলো প্রিয় নবীকে মুহাব্বত করা ও তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ করা।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে এ দুনিয়াতে আগমন করে ইসলামের আলো ছড়াবেন, তা মহান আল্লাহ্ বহুকাল পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিলেন। পবিত্র মিলাদুন্নবীর ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। মিলাদ মাহফিলের সূচনা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালা। নবীগণের মহাসম্মেলন ডেকে মিলাদ আয়োজন করেছিলেন আল্লাহ্। ঐ মজলিশে লক্ষাধিক পয়গম্বর (আঃ) উপস্থিত ছিলেন। মজলিশের উদ্দেশ্য ছিল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর বেলাদত, শান ও মর্যাদা অন্যান্য নবীগণের সামনে তুলে ধরা এবং তাঁদের থেকে সাহায্য ও ঈমান আনয়নের প্রতিশ্রুতি আদায় করা। কুরআন মজিদের সূরা আলে ইমরান (৮১–৮২) নং আয়াতে এই মাহফিলের উল্লেখ রয়েছে।
কুরআনেও নবীজির রেসালতের বিষয়ে আল্লাহ্ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যেমন, আল্লাহ বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রভু ও স্রষ্টা নই?’ তখন সমস্ত বনী আদম উত্তরে বলেছিল ‘হ্যা’। তাওহীদের ক্ষেত্রে একবার অঙ্গীকার যথেষ্ট, কিন্তু রিসালাতের ক্ষেত্রে বার বার অঙ্গীকার প্রয়োজন। নবী মানুষের মধ্যেই অবস্থান করবেন; তাঁর দৈনন্দিন জীবন, খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা মানুষের মতই হবে। এজন্য নবীজির নবুয়ত ও রিসালাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা সহজ নয়। নবীজির শান-মান অস্বীকারকারীকে কাফের হিসেবে বর্ণনা করেছেন আল্লাহ্।
বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা বহু বছর ধরে ১২ রবিউল আউয়াল, নবীজির পবিত্র বেলাদত দিবস উদযাপন করে আসছেন। মিলাদুন্নবী, উরসুন নবী, জশনে জুলুস ইত্যাদি অনুষ্ঠান শরীয়তের দৃষ্টিতে হাছান ও মোস্তাহাব। উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এ সমস্ত অনুষ্ঠান হুজুর (সা.) এর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান, দূরুদ ও সালাম পেশ করার অতি উত্তম এবাদত।
ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে প্রিয় নবীর সঠিক পরিচয় জানা, তাঁর সমস্ত গুণে বিশ্বাস ও আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী এবাদত করা জরুরি। আল্লাহ্ বলেন: “আ-মানূ বিল্লা-হি ওয়া রসূলিহি” (সূরা হাদিদ, ৫৭:৬) অর্থাৎ, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনো। নবীজি মুসলমানদের প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয়; যেহেতু তাঁর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ছাড়া কেউ প্রকৃত মু’মিন হতে পারে না। বাহ্যিক সুন্নাত পালনকে নবীপ্রেম ভাবা ভুল; সত্যিকারের নবীপ্রেম হলো আনুগত্য ও পদাঙ্ক অনুসরণ।
আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই ঈদে মিলাদুন্নবীর মূল উদ্দেশ্য। কুরআন এ সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন: ‘লায়ীন শাকারতুম লাআযী-দান্নাকুম ওয়ালাইন কাফারতুম ইন্না ‘আযা-বী লাশাদী-দ।’ (সূরা আল-ইমরান, ১৪:৭) অর্থাৎ, “কৃতজ্ঞ হলে আমি তোমাদেরকে আরও অধিক দেবো; অকৃতজ্ঞ হলে শাস্তি কঠোর।”
ঐতিহাসিক স্মরণ ও প্রার্থনা, আলোচনা সভা, কুরআন খানি, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ ধর্মীয় শিক্ষার যথার্থ প্রয়োগ ও ইতিহাস সংরক্ষণের সুযোগ পায়। এগুলো না পালন করলে ইতিহাস বিস্মৃতির অন্ধকারে বিলীন হতে পারে। যারা ইসলামের স্মরণীয় দিবসের গুরুত্ব বোঝে না, তারা আল্লাহর নূর নিভাতে চায়; তবে আল্লাহ্ নিজ নূরকে পূর্ণ করবেন।
রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন: “ক্বুল বিফাদ্বলিল্লাহ-হি ওয়া বিরাহমাতিহী- ফাবিযা-লিকা ফালইয়াফ্রাহু হুয়া খাইরুম মিম্মা- ইয়াজমা‘উন” (সূরা ইউনুস, ১০:৫৮)
অর্থাৎ, “আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার উপরই আনন্দ প্রকাশ করা উচিত, যা ধন-দৌলতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।” প্রিয় নবীর পদাঙ্ক অনুসরণে মানবজাতি আলোর পথে পরিচালিত হয় এবং বিশ্ববাসী আশ্রাফুল মাখলুকাত হিসেবে মর্যাদা পায়।
পবিত্র কুরআন (সূরা আম্বিয়া, ১৭) অনুযায়ী প্রিয় নবীকে নেয়ামত হিসেবে স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের মূল লক্ষ্য। এতে দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তি এবং কল্যাণ নিহিত। ওয়া সাল্লাল্লাহু তালা খাইরি খাল্কিহী ওয়া নূরে জাতিহী সাইয়েদিনা মুহাম্মদিও ওয়া আলিহী আসহাবিহী আজমাঈন। আমিন। বিহক্কে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
লেখক ইসলামিক গবেষক ও প্রধান নির্বাহী উপদেষ্টা – বাংলাদেশ রেজভীয়া তালিমুস্ সুন্নাহ্ বোর্ড ফাউন্ডেশন