ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা
প্রকাশিত: ২২-৮-২০২৫ দুপুর ৪:৭
প্রবাদ আছে ”মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য” কিন্তু আমি বলি মানুষের জন্য শুধু মানুষই নয় আরো অনেক কিছু আছে। মহান স্রষ্টা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। আর সেই মানুষকে ঘোষণা করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। মানুষকে যেমন বিবেক বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তেমন দিয়েছেন মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা। কিন্তু পৃথিবীতে আরো অনেক জীব, জন্তু, পোকামাকড় বা কীটপতঙ্গকেও দিয়েছেন কিছু বিশেষ ক্ষমতা। নিজস্ব সকীয়তা দান করেছেন প্রত্যেককে আলাদা করে। আমি আজকে তেমন একটি প্রাণীর কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আর এটি কোন কাল্পনিক ঘটনা নয়, এটি আমার বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া এক বিরল ঘটনা।
মূল ঘটনায় আসি, ২০১৭ কি ১৮ সালের কথা, আমি সচরাচর ঘুমিয়ে গেলে রাতে আর উঠিনা বা উঠার প্রয়োজন পড়েনা। গভীর রাতে ওয়াসরুমে যাওয়া প্রবণতা তখনো তৈরি হয়নি। সেদিন ছিল শীতকাল প্রচুর ঠান্ড পড়েছে। গভীর রাতে প্রকৃতির ডাক পড়েছে। সাড়া না দিয়ে কোন উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে ওয়াসরুমে যেতে হলো। বলে রাখি আমার বাসায় বাংলা কমোড ব্যবহার করি। পানি ব্যবহারের জন্য প্লাস্টিকের বদনা। প্রকৃতির কাজ শেষ করে যখন পানি খরচের সময় এসেছে তখন বদনা থেকে পানি ঢালতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হলো। নল দিয়ে পানি আসছেনা। তখন বিকল্প পথে পানি খরচের পর উন্মোচন হলো পানি না পড়ার রহস্য। বদনার নলের ভেতরে আটকে আছে একটি ইঁদুরের ছোট বাচ্চা। আমি সাবধানে তাকে বের করে শুকনো স্থানে রেখে দিলাম। সকালে যখন ঘুম ভেঙেছে ঘড়ির কাটায় তখন প্রায় ১১ টা বেজেছে। আবার ওয়াসরুমে গিয়ে দেখি ইঁদুরের বাচ্চাটি একটু একটু নড়াচড়া করছে। আমি ওকে আর ডিস্টার্ব করিনি। এমনকি বাসার কেউই তাকে ডিস্টার্ব করেনি। সেদিন ইচ্ছে করেই অফিসে একটু লেইটে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিলাম। লাঞ্চের পর প্রায় ৩টার দিকে ইঁদুরটির অবস্থা জানতে ওয়াসরুমে গিয়ে দেখি সেটি নেই, সম্ভবত সুস্থ হয়ে চলে গেছে।
পরের ঘটনায় যাওয়ার আগে আমার বাসা সম্পর্কে একটু বলে রাখি, আমি তখন চট্টগ্রাম শহরে ২ রুমের একটি ভাড়া বাসায় থাকি। সাথে একটি বাথরুম ও একটি কিচেন। কোন রাজকীয় ভবন নয় সেমিপাকা ঘর। আশেপাশে নালা জলাশয়ও আছে। ফলে ইঁদুরের উৎপাত একটু বেশিই ছিল। ঘরে পর্যাপ্ত স্পেস না থাকায় বাথরুমের ছাদের ওপর আমাদের অনেক ব্যবহার্য জিনিষপত্র রাখতে বাধ্য হতাম। কাথা বালিশ লেপ তোষক এমনকি কিছু বইপত্রও বস্তায় ভরে রেখে দিতাম। ইঁদুর সেগুলো কেটে নষ্ট করে ফেলতে পারে ভেবে মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী আমার সাথে কথা কাটাকাটি করতেন। কিন্তু আমার বড় বাসা নেয়ার সামর্থ্য নেই অগত্যা আর কিছুই করার থাকেনা।
নিচতলায় জলাশয়ের পাশে বাসা হওয়ায় আমার বাসায় ইঁদুরের উৎপাত একটু বেশিই ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুন এটাই সত্য যে ইঁদুর আমার বাসায় কোন কিছুই কাটতো না। ইঁদুর আমার বাসার আশেপাশে অনেকের বাসায় বিভিন্ন জিনিষ কেটে তছনছ করেছে কিন্তু আমার বাসায় কিছু কাটেনি বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে। আমি বাসার অনেক জিনিষ চেক করে দেখলাম একটা কাগজ বা কাপড়ের টুকরোও কাটেনি। শুধু ওই বাসায়ই নয় আমি এখনো আমার বাসায় ইঁদুরের হানা নেই। যদিও এখন আমি আর আগের সেই বাসায় থাকিনা। বাসা বদল করেছি, ২য় তলায় থাকি, এই বাসায়ও বাথরুমের ছাদের উপরে কুঠুরি আছে, যেখানে কম প্রয়োজনীয় জিনিষ রেখেছি অনেকদিন হলো। বাসায় ইঁদুরের যাতায়াত আছে কিন্তু কিছুই কাটেনা। আমার পাশের বাসায় কাটে বাট আমার বাসায় কাটেনা। আমি তখনো বুঝতে পারিনি এর রহস্য কি। আমরা ইঁদুর নিধনের জন্য কোন ঔষধও ব্যবহার করিনা।
এই ঘটনা নিয়ে আমি কখনো ভেবে দেখিনি। আমি আমার সৃষ্টিকর্তার ওপরেই আস্থা রেখেছি, তিনিই আমার সবকিছু রক্ষা করছেন। সম্প্রতি লক্ষ্য করলাম আমার বাসার বাথরুমের কমোডে ও আশেপাশের দেয়ালে পিপিলিকার বিচরণ। আমি তাদেরকে এক্সটা কোন খাবার দেইনা, আবার তাদেরকে তাড়িয়েও দেইনা। চাইলে পানি ঢেলে পিপিলিকার দলকে কমোডে ফেলে দিতে পারতাম, কিন্তু তা করিনি। কারন তারা আমার কোন ক্ষতি করছেনা, আমি কেন শুধু শুধু তাদের হত্যা করব? এমন প্রশ্ন আমার ভিতরটাকে জাগ্রত করেছে। এখন আমি বাথরুমে গেলে তারা নিজেরাই নিরাপদে সড়ে যায়। কমোডে থাকেনা। ২/১ টা থাকলেও আমি তাদের যথা সম্ভব নিরাপদ রাখতে চেষ্টা করি। কিন্তু মজার বিষয় হলো কখনো পিপিলিকার পরিমান বেশি দেখলে আমি ফিরে আসি ২/৩ মিনিট পর আবার যাই, ততক্ষণে পিপিলিকারা নিরাপদে সড়ে যায়। আবার লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে আমাদের কোন খাবারে এই পিপিলিকা দেখা যায়না। আমাদের কোন দরকারি জিনিষ এরা নষ্ট করেনা।
এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমার সেই ৭/৮ বছর আগের ইঁদুরের কাহিনীটা মনে পড়েছে। আমার ধারণা করতে কষ্ট হচ্ছে না যে ইঁদুর আমার বাসার কোন জিনিষ নষ্ট করছেনা কেন। আপনারা কি বুঝতে পেরেছেন??
এখন আবারো আসছি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের দিকে। যতই সময় যাচ্ছে কিছু মানুষের ভিতর ততই হিংস্রতা বাড়ছে, মানুষ মানুষের ক্ষতি করছে (সবাই নয়), কারনে করছে আবার অকারনেও করছে। সমাজে আপনি একটু ভালোভাবে চলছেন, দেখবেন কিছু মানুষ আপনার পেছনে লেগেছে। আপনাকে নিয়ে নানারকম কল্পকাহিনী সাজাচ্ছে। এমন যারা করছে, কেন করছে তাও হয়তো আপনি জানেন না। তারা চায় আপনার অবস্থান তাদের চেয়ে খারাপ হোক। আবার কিছু মানুষ আছে যারা অন্যেও উপকার করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আবার এটারও যথেষ্ঠ কারন আছে। কারন একসময় আপনি যার উপকারে লেগেছেন সেই লোকই কোন কারন ছাড়াই আপনার চরম শত্রুতে পরিনত হয়েছে। সাময়িক সামান্য কিছু পাওয়ার আশায় বা অকারনে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, ছোটখাট বিষয়টি জগড়া লেগে যাচ্ছে। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিচ্ছে এমনকি হিসেবে না মিললে খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। সেই আমরা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছি। সাধারণত পশু পাখির মনেও ভালোবাসা বা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে সেই পরিমান বোধ আজ মানুষের মাঝে নেই। কালের পরিবর্তণে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে বা গেছে। আগের সেই বন্ধুত্ব এখন তেমন একটা চোখে পড়েনা, নিখাঁদ ভালোবাসার বড়ই অভাব। আমাদের ছেলেবেলার বন্ধুত্ব আর এখনকার বন্ধুত্বের মাঝে বিস্তর ফারাক।
আমার এই লোখা মানুষকে ছোট করার জন্য নয়, একটা বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম কৃতজ্ঞতাবোধ শুধু মানুষের মাঝেই নয়, প্রকৃতির মাঝেও আছে। কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় এমনকি সব প্রাণীর মাঝেই আছে। কোন প্রাণীই মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করেনা। আপনি নিজেই এর প্রমান পাবেন, যদি একটু চেষ্টা করেন। যখন সে কারো মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন সে ভয়ে জীবন রক্ষার্থে আক্রমন করে। বিষাক্ত কিটগুলোও মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে এমনকি বিষধর সাপও বিনা কারণে মানুষকে ছোঁবল দেয়না। খোজ নিয়ে দেখুন যাকে কামড়েছে তার কাছ থেকে কোন না কোনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
সকল মানুষ খারাপ নয় সমাজে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে, খারাপের সংখ্যা খুবই কম। তবে খারাপের প্রচার বেশি হয় বলে অনেকেই মনে করেন, সমাজে ভালো মানুষ নেই। প্রকৃতপক্ষে ভালো মানুষগুলো সমাজে কোনঠাসা হয়ে আছে। নিজেদের ইজ্জত রক্ষার্থে খারাপ মানুষগুলোর অপকর্মে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
বিশেষ নোট: অকারনে কারো ক্ষতি করা মোটেই উচিৎ নয়, হোক সেটা মানুষ বা কোন পশু পাখি। পারলে তাদের ভালোবাসুন, তারাও আপনাকে ভালোবাসবে। মানুষ বেঈমানী করতে পারে কিন্তু বোবা প্রাণীরা কখনো বেঈমানি করেনা। তারাও কোন না কোনভাবে সমাজের উপকারে লাগে। তাই নিজেদের স্বার্থে সকল প্রজাতি রক্ষা করা একান্ত অপরিহার্য। সবশেষে স্বামী বিবেকানন্দের সেই বানীটাই প্রমানিত ”জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিচ্ছে ঈশ্বর”।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।