ঈশ্বরদী পদ্মানদীর তীরে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ আমলের সাঁড়া ঘাটের অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক

news paper

এএ আজাদ হান্নান, ঈশ্বরদী

প্রকাশিত: ২১-৮-২০২৫ দুপুর ১২:৪১

75Views

পাবনা জেলার ঈশ্বরদী পদ্মানদীর তীরে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ আমলের ঐতিহাসিক সাঁড়া ঘাটের অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক। একসময় নাবিকদের কোলাহলে মুখরিত পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর সাঁড়া ঘাট এখন পর্যটকদের পদচারণায় মুখর। ব্রিটিশ আমলের সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে ঈশ্বরদী শহরের পশ্চিমে তিন কিলোমিটার দূরের পদ্মা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে এই স্থানটি। পুরনো সেই জৌলুস না থাকলেও, সময়ের সাথে সাথে এটি এখন একটি জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ব্রিটিশ আমলের সমৃদ্ধ সাঁড়া ঘাট ব্রিটিশ শাসনামলে সাঁড়া ঘাট ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সাঁড়া রেলওয়ে স্টেশন, সাঁড়া মাড়োয়ারি উচ্চ বিদ্যালয়, সাঁড়া পান হাট এবং সাঁড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দেশ-বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন আকারের জাহাজ ও স্টিমার এই ঘাটে ভিড়তো, যা নাবিকদের আনাগোনায় মুখরিত ছিল। সে সময় সাঁড়া রেল স্টেশন থেকে ভারতের দার্জিলিং, শিলংসহ বিভিন্ন প্রদেশে ট্রেন চলাচল করত। কয়লা চালিত ডাব্লিউডি স্টিম ইঞ্জিনের খসখস শব্দ শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে যুবক-যুবতীরা ছুটে আসতো রেললাইনের ধারে। তখন সাঁড়া ঘাটে এক টাকায় বড় আকারের এক ডজন ইলিশ মাছ পাওয়া যেত, যার সুগন্ধে এলাকাটি ভরে থাকতো। সাঁড়া ঘাটের গুরুত্ব বিবেচনা করে সাঁড়াব্রিজ এবং পাকশী শহরের জন্ম হয়েছে। ১৯০৪ সালে পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেলস এই সেতুর নকশা তৈরি করেন, যার জন্য পাকশীতে একটি তিনতলা বাংলো নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯০৯ সালে শুরু হয় সাঁড়া সেতুর নির্মাণ কাজ। ১৯১৫ সালের ৪ঠা মার্চ এই সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরুর আগেই পদ্মা নদীর তীরে স্থাপন করা হয় বিশাল পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে অফিস। এই অফিসকে কেন্দ্র করেই আজকের পাকশী শহর গড়ে ওঠে। এক সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রেন চলাচলের নিয়ন্ত্রণ অফিস ছিল এটি, যা বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় অফিস নামে পরিচিত। এই সেতুটিই বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক সেই দিনগুলো এখন অতীত হলেও, সাঁড়া ঘাট তার আকর্ষণ হারায়নি। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী এখানে আসেন নির্মল বিনোদনের খোঁজে। পদ্মা নদীর ঢেউয়ের কলকল শব্দ, খোলা বাতাস এবং মনোমুগ্ধকর পরিবেশের কারণে এটি একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। ঘাটের আশেপাশে এখন অসংখ্য ছোট-বড় দোকান গড়ে উঠেছে, যেখানে ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি এবং চায়ের স্টল রয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী নৌকা ভ্রমণে পর্যটকদের নিয়ে বাড়তি আয় করছেন। পর্যটকদের আনাগোনায় এখানে প্রায়ই গান-বাজনার আসর বসে, যা স্থানটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। পুরনো দিনের ইতিহাস আর বর্তমানের বিনোদনের মিশেলে সাঁড়া ঘাট আজও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। এই স্থানটি কেবল একটি ঘাট নয়, বরং এটি ব্রিটিশ আমলের একটি জীবন্ত ইতিহাস, যা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তার নতুন রূপ খুঁজে নিয়েছে। সাঁড়া ঘাট, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় অবস্থিত, একসময় পদ্মা নদীর উপর এই ঘাটে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে ফেরি ঘাট ছিল। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু হওয়ার আগে এই ঘাটটি রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ১৮৭৮ সালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির রেলপথটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি অংশ কলকাতা থেকে পদ্মার দক্ষিণ তীরে অবস্থিত দামুকদিয়া ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এরপর নদী পার হয়ে পদ্মার উত্তর তীরে অবস্থিত সাঁড়া ঘাট থেকে আরেকটি রেলপথ শিলিগুড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এই দুটি অংশের মধ্যে যাত্রী ও মালামাল পারাপারের জন্য সাঁড়া ঘাট ও দামুকদিয়া ঘাট রেলওয়ে ফেরি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে সাঁড়া ঘাটের সেই রেলওয়ে ফেরি বা স্টেশন আর নেই। পদ্মা নদীতে ব্যাপক ভাঙনের কারণে এবং ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু হওয়ার পর ঘাটটি তার গুরুত্ব হারায়। এখন এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যেখানে স্থানীয়রা এবং দূর থেকে আসা পর্যটকেরা পদ্মার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে এখানে প্রচুর মানুষের আনাগোনা দেখা যায়। পর্যটন ও স্থানীয় অর্থনীতির মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে সাঁড়া ঘাটের নৌকা ভ্রমণ ও বিভিন্ন ছোট বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালুর মধ্যদিয়ে। পর্যটন এবং স্থানীয় অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে। যখন কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান বা দর্শনীয় কেন্দ্র মানুষের কাছে পরিচিত হয়, তখন শুধু সেই স্থানের সৌন্দর্যই প্রকাশ পায় না, বরং তার আশেপাশে একটি নতুন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রও তৈরি হয়। বর্তমানে অনেক এলাকাতেই দেখা যায়, পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অসংখ্য চটপটি, ঝালমুড়ি, ফুচকার দোকান, নানা রকম হস্তশিল্পের দোকান এবং বিভিন্ন প্রকারের ভোজনশালা গড়ে উঠেছে। এগুলোর ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য আয়ের নতুন উৎস তৈরি হয়েছে। পর্যটকদের আগমনকে কেন্দ্র করে যেসব ছোট-বড় ব্যবসা গড়ে ওঠে, সেগুলো সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। নৌভ্রমণ, স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং হস্তশিল্পের পসরা সাজানো দোকানগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যা শেষ পর্যন্ত সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই কর্মকাণ্ডগুলো কেবল পর্যটন খাতকেই শক্তিশালী করে না, বরং স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও সহায়তা করে। এই ধরনের উদ্যোগগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে তা স্থানীয় অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ এবং টেকসই করতে পারে।


আরও পড়ুন