অনিকেত জীবনের গল্প
প্রকাশিত: ৯-৮-২০২৫ দুপুর ১১:৫২
বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিতেই কিশোর কুমারের গান মন ভরিয়ে দিল। অনেক দিন ধরে লেখার চেষ্টা করেও আর হয়ে উঠছিল না। জগৎ-সংসারের নানা ব্যস্ততা আর জ্বালা-যন্ত্রণা নিজের জন্য একটুও সময় দিচ্ছিল না। অবশেষে জীবনই আজ দারুণ এক সুযোগ করে দিল। জীবনটা খুব দীর্ঘ না হলেও এক আকাশ সমান দুঃখ, অবজ্ঞা, অবহেলা আর একাকীত্বে ভরা। প্রকৃতি হয়তো পরম যত্নে এরই নাম দিয়েছে 'অনিকেত'।
'অনিকেত' নামটি আমার পিতৃ-মাতৃকুলের দেওয়া নয়। কোনো এক অমাবস্যা তিথিতে জীবনের সঙ্গে এটি নিজে থেকেই জড়িয়ে গেছে। এই অনিকেত জীবনের পড়ন্ত বেলায় কিছু লিখতে বসে কত স্মৃতিই না মনে পড়ছে! ভক্তদের অনুরোধ আর আক্ষেপ মেটাতেই আজ কলম ধরেছি। লিখব অনিকেত জীবনের নানা উত্থান-পতন, রোগ-শোক আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গল্প। তার থেকেও বড় কথা, সাক্ষাৎ পরীকেও হার মানানো আমার দুই রাজকন্যার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই গল্প লেখার চেষ্টা করছি।
ঝিনাইদহ জেলার আরাপপুর স্ট্যান্ড থেকে কুষ্টিয়া মহাসড়ক ধরে এগোলে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যাবে। একটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ। যারা ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে পড়ানোর স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য এটি একটি সেরা পছন্দ হতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজগুলোর মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ঝিনাইদহ ছোট্ট জেলা হলেও ইতিহাস ও ঐতিহ্যে এর দারুণ সুনাম রয়েছে। এই জেলার মানুষের জীবনমান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও এর অন্যতম কারণ।
ক্যাডেট কলেজ থেকে আরও একটু সামনে গেলেই আমতলা বাজার। বাজারটির নাম কেন আমতলা হয়েছে, তা জানতে গেলে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস জানতে হবে। কিন্তু অনিকেত মন সেদিকে যেতে চাইছে না। আমতলা বাজার থেকে মহাসড়ক ছেড়ে এবার আপনাকে গ্রামের দিকে প্রবেশ করতে হবে। এখানকার গ্রামীণ সৌন্দর্য না দেখলে আপনি বাংলার আসল রূপ বুঝতে পারবেন না। মকিমপুর, বড় ভাদড়া, ছোট ভাদড়া, ভোলার মোড়, কন্যাদহ, দুর্লভপুর এবং সাবেক কাছারিবিন্নী পার হয়ে ডানদিকে মোড় নিলেই দেখা যাবে বেড়বিন্নী গ্রাম। এই ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রামটি আপনাকে 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেবে।
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ৮ নং চাঁদপুর ইউনিয়নটি রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অস্তিত্বের নাম। এই পবিত্র মাটিতেই বাঘা-বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে। বেড়বিন্নী গ্রামটি সুদূর অতীত থেকেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এখানে জোয়ার্দার বংশের ইতিহাস সবারই জানা। এই বংশের পূর্বপুরুষদের পদচারণাতেই গ্রামটি সৃষ্টি হয়েছিল। সৌনাল্য জোয়ার্দারের প্রভাব-প্রতিপত্তি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। গ্রামটির অবকাঠামো থেকে শুরু করে প্রায় সবক্ষেত্রেই জোয়ার্দারদের রয়েছে এক অনবদ্য অবদান।
আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়? অনিকেত চরিত্রের বদলে নিজেকেই কল্পনা করি, কি বলেন? আমার সঠিক জন্মতারিখ জানতে মায়ের টিনের বাক্স খুঁজে একটি টিকা কার্ড পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৮৯। সেদিন আমি আনন্দে ভেসেছিলাম। যদিও সার্টিফিকেটের সঙ্গে সেই তারিখ একদমই মেলে না! সেখানে কেরানি মহাশয় দারুণ দূরদর্শিতা দেখিয়ে জন্মতারিখ লিখেছিলেন ০১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০! আমার দাদা এবং নানা বাড়ি কাকতালীয়ভাবে এই বেড়বিন্নী গ্রামের একই বংশে। দুজনেই জোয়ার্দার তকমা নিয়ে অনেক দিন আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমার নানার নাম নায়েব আলী জোয়ার্দার। তিনি একটি পুত্রসন্তানের আশায় এগারোটি কন্যাসন্তানের জনক হয়েছিলেন। যদিও তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচটি মেয়েই বেঁচেছিল। পাঁচ মেয়ের মধ্যে আমার মা সবার ছোট। এজন্য তিনি সবার থেকে বেশি আদর-ভালোবাসা পেয়েছিলেন। নানাভাই এবং নানি মাকে খুব ভালোবাসতেন।
পুত্রসন্তান না থাকায় এবং কিছু সম্পত্তি থাকায় নানাভাইকে প্রায়ই বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে হতো। হয়তো এজন্যই তিনি মাকে গ্রামেই বিয়ে দিয়েছিলেন। সে এক রোমাঞ্চকর গল্পকথা! মজার হলেও সত্যি যে, জোয়ার্দার বংশের কারো হাতেই যে এমন একটি উপন্যাসের সূত্রপাত হবে, তা কেউ কি কোনোদিন ভেবেছিল!................(চলবে)