টাকার গরমে নির্মিত মসজিদ দুনিয়ায় ‘শাদ্দাদের বেহেস্ত’

বালাগঞ্জে পঞ্চায়েতের জামে মসজিদকে ডিঙিয়ে জেদ করে ২ কোটি টাকায় ‘পাঞ্জেগানা’ মসজিদ

news paper

বালাগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৩-৮-২০২৫ দুপুর ৪:২০

155Views

পাশাাপাশি ২টি মসজিদ। মাঝখানে মাত্র ২শ ফুটের একখণ্ড ভূমি। নিকটবর্তী মসজিদ দুটির অবস্থান হওয়ায় দেখতে দৃষ্ঠিকটু লাগছে। অন্যদিকে ওই এলাকার মানুষকে নিয়ে বাইরের লোকজেনের নেতিবাচক মন্তব্যেরও শেষ নেই। পাশাপাশি অবস্থিত এই মসজিদ দুটির দেখা মিলে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার বালাগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ রিফাতপুর গ্রামে। রিফাতপুর গ্রামের দক্ষিণদিকে যে পাড়াটির অবস্থান সেটি দক্ষিণ রিফাতপুর নামেই পরিচিত। 
জানা গেছে, ২০০৬ সালে এই পাড়াবাসীর উদ্যোগে সিনসেডের নির্মিত মসজিদটি কয়েক বছর আগে পাকা করে নির্মাণ করা হয়। পাড়াবাসী বা ওই পঞ্চায়েতের লোকজনের নির্মিত জামে মসজিদের প্রায় ২শ ফুট দক্ষিণে ২০১৮-১৯ সালের দিকে আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ওই পাড়ার বাসিন্দা খুর্শেদ আলীর ছেলে জমশেদ আলী। প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত টাইলস লাগানো বিশাল এই মসজিদে শুধুমাত্র জমশেদের পরিবারের লোকজন নামাজ পড়েন। কোনো কোনো সময় কেউ নামাজও পড়েন না।
ওমানের শাদ্দাদের বেহেস্তের জনশ্রুতি সবারই জানা। যিনি শাদ্দাদ ইবনে আদ বা শাদ্দাদ বিন আদ নামে পরিচিত। তিনি আদ জাতির বাদশা ছিলেন। কথিত আছেÑ তিনি ইরাম নামের একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন, যা মরুভূমির আটলান্টিস নামেও পরিচিত। খুবই ক্ষমতাশালী এবং সম্পদশালী বাদশা শাদ্দাদকে একজন নবী আল্লাহর একত্ববাদের দিকে ডাকেন, তখন শাদ্দাদ নিজের ক্ষমতা ও সম্পদ দিয়ে বেহেশত বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই কল্পিত বেহেশত বানানোর কাহিনিই ‘শাদ্দাদের বেহেশত’ নামে পরিচিত। জমশেদ পরিবারের নির্মিত পাঞ্জেগানা মসজিদটি দেখে অনেকেই দুনিয়ায় ‘শাদ্দাদের বেহেস্ত’ বলেও মন্তব্য করেছেন। 
ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, ‘যে মসজিদ নির্মাণ করা হয় লৌকিকতা প্রদর্শনের জন্য, জেদবশত, পার্থিব উদ্দেশ্যে বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্য কিংবা অপবিত্র ও অবৈধ অর্থে যেটি নির্মাণ করা হয়েছে, ইসলামী শরিয়ত মতে তা মসজিদে জেরারের অন্তর্ভুক্ত। মসজিদে জেরার মানে ফেৎনা বা ক্ষতিসাধনের মসজিদ। টাকার গরমে যত্রতত্র মসজিদ নির্মাণে ফেৎনা সৃষ্টি ইসলাম সমর্থন করে না’। মসজিদটি নির্মাণের শুরুর দিকে এলাকাবাসীকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এটি পাঞ্জেগানা মসজিদ হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে। কখনও মাইক ব্যবহার করা হবে না। অথচ কিছুদিন আগে মাইক লাগানোয় ওই গ্রামের লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জমশেদ পরিবারের লোকজন এলাকাবাসীকে অমান্য ও তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে টাকার গরমী দেখিয়ে সম্প্রতি এই পাঞ্জেগানা মসজিদের পরিধি বা আকার-আয়তন বৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণ করে ২য় ও ৩য় তলা নির্মাণের উদ্যোগে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। 
গ্রামের লোকজন বলছেন, গ্রামের জামে মসজিদের ২শ ফুট দূরত্বে পাঞ্জেগানা মসজিদটি নির্মাণ করায় বাইরের লোকজন এই এলাকা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এনিয়ে বাইরের আত্মীয়-স্বজনের প্রশ্নের মুখে পড়েন তারা। এমনকী গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বিয়ের সমন্ধ আসলে নতুন মেহমানরা নেতিবাচক দৃষ্ঠিতে ব্যয় বহুল পাঞ্জেগানা মসজিদ নিয়ে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলে গ্রামের লোকজন মেহমানদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে লজ্জায় মুখ ঢাকেন। গ্রামবাসী জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে গ্রামের জামে মসজিদটি নির্মাণকালে জমশেদকে সেই মসজিদে অনুদান দেওয়া ও পৃষ্ঠপোষকতা করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে গ্রামবাসীর কথা অমান্য করে গ্রামবাসীর সাথে পঞ্চায়েতবদ্ধ না হয়ে টাকার গরম দেখিয়ে একাই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগী হলে গ্রামবাসী তাতে বাধা দেন। অভিযোগ রয়েছে, বৃহত্তর রিফাতপুর গ্রামের কথিপয় মোড়লদের বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে প্রথমে তার বসতবাড়ির সীমানায় ছোট করে পাঞ্জেগানা মসজিদ নির্মাণের প্রস্তুতি নেয়। পরবর্তী সময়ে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ হওয়া এসব কথিপয় গ্রাম্য মোড়লদের প্রভাবে প্রাতবাদী গ্রামের মানুষকে মামলার হুমকি দিয়ে গ্রামের জামে মসজিদের অতি নিকটে রাস্তার পাশের প্রায় ৪০শতাংশ ভূমিতে প্রায় দুই-আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে এই মসজিদ নির্মাণ করে। গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে, বিষ্মিত হওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে- জমশেদ বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হলেও তার এক ভাই ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রয়াত মাসহ ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের ভরণ-পোষণ দেয়াতো দূরের কথা ষাটোর্ধ্ব চিরকূমার আরেক ভাইকে বিয়ে করায়নি সে। তবে, কারো সাথে মামলা-মোকদ্দমা লাগলে আধিপত্য দেখাতে টাকা-পয়সা ঢেলে দেয়। তার পরিবারাটি এলাকায় মামলাবাজ হিসেবে পরিচিত, কথায়-কথায় মানুষের নামে মামলা করাই তাদের নেশা। বিগত পঞ্চাশ বছরে প্রায় শতাধিক মামলা করার রেকর্ড তাদের পরিবারের। মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা জমশেদের ভাতিজা আবজল আলী কালাই দস্তখত শিক্ষিত হলেও ভূমির দলিল-পরচা ও মামলার আইন-কানুনে খুবই পারদর্শী, দেওয়ানি-ফৌজদারী আইনের ধারাগুলোর অনেকটাই তার মুখস্থ।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, পাঞ্জেগানা মসজিদের উঁচু গোম্বুজে মাইক লাগানো হয়েছ। মসজিদ সম্প্রসারণ কাজের জন্য নির্মাণ সামগ্রী এনে মসজিদের পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। গ্রামবাসীর অভিযোগ, জমশেদের পরিবারের লোকজন গ্রামের মানুষদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলেন। মসজিদ নির্মাণের পর তারা গ্রামের লোকজনকে নানা প্রলোভন দেখালেও কেউ তাদের মসজিদে নামাজ পড়তে যান না। এখন তারা গ্রামের লোকজনের মধ্যে কৌশলে দ্বন্ধ সৃিষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। গ্রামবাসীর আশঙ্কা, মসজিদের সম্প্রসারণ কাজ শুরু হলে অতিতের ন্যায় টাকার জোরে দম্ভ করে তারা গ্রামের লাকজনকে ইঙ্গিত করে নানা কটুকথা বলবে। কেউ প্রতিবাদ করলে মামলার হুমকি দেবে। এতে জমশেদ ও তার পরিবারের কুকাণ্ড নীরবে শয়ে যাওয়া লোকজন বড় ধরনের সংঘাতের জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এই মসজিদটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং কেয়ামত পর্যন্ত ফেৎনা সৃষ্টির একটা কারণ হয়ে থাকবে। এটি অপসারণে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের দৃষ্ঠি কামনা করেছেন তারা। মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা জমশেদের ভাতিজা আবজল আলী কালাই বলেন, আমাদের টাকা-পয়সার কোনো কমতি নাই, আমরা আমাদের ইচ্ছামতো মসজিদটি বানিয়েছি। এখন ২য় ও ৩য় তলার কাজ শুরু করবো, ইচ্ছে হলে ৫ম তলা পর্যন্ত করতে যদি দশ কোটি টাকা খরছ করতে হয় তা-ও করবো। কে কী বললো তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না।


আরও পড়ুন