গোপালগঞ্জ সহিংসতা: বিচার বিভাগীয় তদন্ত, 'আয়না ঘর' পুনরাবৃত্তি নয়
প্রকাশিত: ২২-৭-২০২৫ দুপুর ৪:০
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় সরকার একটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, এই কমিটি একজন বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত হবে এবং এতে শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। তিনি আশা করছেন, আগামী দু'এক দিনের মধ্যেই এই কমিটি গঠন করা হবে।
মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে মতবিনিময়কালে উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ঘটনার দিন কী ঘটেছিল এবং কেন ঘটেছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। তিনি স্পষ্ট করেন যে, প্রধান উপদেষ্টা তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠিয়েছেন, ঘটনার তদন্তের জন্য নয়। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য সরকার বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখবে বলে তিনি জানান।
উপদেষ্টা বলেন, এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে স্থানীয় কর্মকর্তারা জানালেও, এর ব্যাপকতা এত বড় হবে তা কেউ অনুমান করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে সীমিত সম্পদ ও লোকবল নিয়ে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক কষ্ট স্বীকার করেছে। তিনি তাদের দায়িত্ব পালনে নানা প্রতিকূলতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্ট করেছেন এবং সাংবাদিকরাও আহত হয়েছেন।
মতবিনিময় সভায় তিনি আশ্বস্ত করেন যে, এখানে আশঙ্কার কিছু নেই, কারণ এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি দল নিরপেক্ষ সরকার, যা শহীদদের রক্ত এবং ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার আহতদের আত্মত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেন, "গোপালগঞ্জও আমাদের কাছে যা, আমাদের নিজের জেলাও তাই। প্রধান উপদেষ্টা সেই বার্তাটাই দিয়েছেন।" তিনি আশ্বাস দেন যে, যারা অন্যায় করেছে, পুলিশের গাড়িতে আগুন দিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও কর্মকর্তাদের উপর হামলা করেছে, তারা অবশ্যই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে। তবে তিনি এও নিশ্চিত করেন, যেন অন্য কেউ হয়রানির শিকার না হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বাভাবিক জীবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, সরকার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গণতন্ত্রের চর্চা করার চেষ্টা করছে, যেখানে আগে গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। তিনি 'আয়না ঘরে' নিয়ে যাওয়া এবং বিরোধী দলমতকে দমন করার মতো অতীতের ঘটনাগুলোর পরিবর্তন হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তাদের মত প্রকাশ করতে পারবে, তবে দায়িত্বশীলতার সাথে। তিনি আশা করেন, একটি সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে উঠবে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুন্দর ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে, যাতে মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, পোলিং এজেন্টরা প্রকাশ্যে ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা দেখতে পাবেন। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা প্রয়োজন এবং যেই নির্বাচিত হয়ে আসবে তাদের সরকার সহায়তা করবে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে সমস্যা আরও বাড়বে উল্লেখ করে তিনি নির্বাচনকে একটি অগ্নি পরীক্ষা হিসেবে অভিহিত করেন এবং সকলের সহায়তায় উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
গোপালগঞ্জে নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হবে না। পুলিশ বা কোনো দপ্তর থেকে মামলা দিলেই সেটা চূড়ান্ত নয়। এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে এবং চেষ্টা করা হবে যাতে কোনো নিরীহ মানুষ হয়রানি না হয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারাও বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
এর আগে সকালে এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন স্থাপনা দুই উপদেষ্টা পরিদর্শন করেন। সকাল সাড়ে দশটায় সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জেলা কারাগারে আসেন। এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার পরিদর্শন করেন এবং কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন। এরপর দুই উপদেষ্টা গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কের এনসিপির সভামঞ্চ, সংঘর্ষের স্থান, জুলাই স্মৃতিস্তম্ভসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে দেখেন।
এ সময় মন্ত্রী পরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লে. জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ, কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক, গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান, পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, জেলার তানিয়া জামান, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম. রকিবুল হাসান সহ দুই মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা এবং আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।