বখরা তুলেন এএসআই রিপন

কানাইঘাট সীমান্তের চোরাচালান ওসির নিয়ন্ত্রণে

news paper

সিলেট ব্যুরো অফিস

প্রকাশিত: ২১-৭-২০২৫ দুপুর ২:৪১

552Views

সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের চোরাচালান বাণিজ্য কোন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা স্থানীয় প্রশাসন। যদি প্রতি সপ্তাহে কোটি কোটি টাকার চোরাচালান বিজিবির হাতে আটক হচ্ছে। তবে সীমান্তের গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর থানার সকল চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠেছে কানাইঘাট সদর ইউনিয়ন।  জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত এলাকার সেনা ক্যাম্প ফাঁকি দিতে চোরাচালানোর পণ্য দরবস্ত চতুল হয়ে কানাইঘাট এলাকা দিয়ে সিলেট সহ সারাদেশে পাচার হচ্ছে। ভারতীয় পাহাড়ি-স্থল সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে আসা ভারতীয় চোরাই চিনি, গরু, মহিষ, কসমেটিক্স, বিড়ি, মোটরবাইক, মাদক, অস্ত্র সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য কানাইঘাট থানার বিভিন্ন রোড দিয়ে সিলেট শহরে অবাধে নিয়ে যাচ্ছেন চোরাকারবারিরা। কানাইঘাট থানা সদরের অদূরেই জকিগঞ্জ উপজেলার শাহবাগ ও সিলেট জকিগঞ্জ সড়ক। এ সড়কের শাহবাগ স্টেশন হয়েই গাড়ি দিয়ে চোরাই পণ্য সরবরাহ করা হয় সিলেট সহ সারাদেশে।
এদিকে কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি বোরহান উদ্দিন রোড দিয়ে সিলেটের বাইপাস সড়ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছায় চোরাইপণ্য। চোরাচালানের সব চেয়ে নিরাপদ রোড এখন কানাইঘাট থানার রোডগুলো। এদিকে শাহবাগ থেকে জকিগঞ্জ থানা সদর অনেক দূরবর্তী হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালে অনেকটা বাইরে এলাকাটি। ফলে কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট সীমান্ত দিয়ে দেশে আসা চোরাইপণ্যের বেশির ভাগ কানাইঘাট সদর ও শাহবাগ স্টেশন দিয়ে নির্বিঘেœ সারাদশে সরবরাহ হচ্ছে। উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের বড়বন্দ এলাকার হারুন, ফয়ছল, রুবেল, খাজই, নাজরান, আলঙ্গীর, লোকমান, হেলাল, ফয়াজ সহ বেশ কয়েকজন ভারতীয় চা-পাতার সাথে কসমেটিকস ও মাদক সামগ্রী নিয়ে এসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছে। দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের দীঘিরপার ও আন্দুরমুখ বাজার এলাকা দিয়ে ভারতীয় চিনি ও চা পাতা চোরাচালানের সাথে জড়িত দিঘীরপার গ্রামের বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিন, লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের ভাটিবারা পৈত গ্রামের আওয়ামিলীগ নেতা রঞ্জন, দিঘীরপার গ্রামের রুবেল, জাকারিয়া, জয়ফৌদ গ্রামের আব্দুস সালাম, ইউপি সদস্য শাহাব উদ্দিন, আব্দুস শুক্কুর। মাদক ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িত লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের সোনারখেড় গ্রামের কুটি মিয়ার পুত্র বোরহান উদ্দিন, আতাউর রাহমানের পুত্র বিলাল আহমদ,আব্দুল মন্নানের পুত্র শফিক আহমদ, নারাইনপুর গ্রামের শামীম আহমেদের পুত্র আব্দুল করিম, তাহির আলীর পুত্র সফির আহমদ।
এদিকে থানার ওসি আব্দুল আউয়ালের বিরুদ্ধে চোরাচালান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মামলায় ওপেন ভাবে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ করেছেন এক ভুক্তভোগী। তিনি সিলেট পুলিশ সুপার বরাবরে ওসির বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি লিখিত ভাবে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগকারী উপজেলার উজান বীরদল গ্রামের জাকারিয়া আহমদ।
পুলিশ সুপার বরাবরে দেওয়া অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ওসি আব্দুল আউয়াল থানায় যোগদানের পর থেকে পর থেকে যত ধরনের অবৈধ কাজ আছে সবই করছেন ওসি আব্দুল আউয়াল। সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় গরু, চিনি, বিড়ি, পেয়াজ, ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা হিসাবে লক্ষ-লক্ষ টাকা আদায় করছেন। জাকারিয়া উল্লেখ করেন তার খালাত ভাই লোকমানের একটি মামলা বিষয়ে জানতে গেলে ওসি বলেন "যদি এক লক্ষ দাও তাহলে তোমার খালাত ভাইয়ের মামলা ফাইনাল রির্পোট দিয়ে দিব'। জাকারিয়াকে ওসি বলেন, এসব টাকার অংশ 'এসপি স্যার ও ডিআইজি স্যারকে দিতে হবে"। উক্ত মামলার ফাইনাল রির্পোট দিতে প্রথমে তিনি ষাট হাজার টাকা ওসিকে ঘষু দেন। এখন ঘুষের বাকি ৪০হাজার  টাকা দেওয়ার জন্য ওসি তাকে হুমকি দিচ্ছেন বলে তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন। উক্ত অভিযোগের সাক্ষ্য নিয়েছেন একজন এএসপি। এদিকে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে আসা ভারতীয় পণ্যগুলো দরবস্ত হয়ে কানাইঘাট সড়ক হয়ে সুরমা ব্রীজের উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার কানাইঘাটের পূর্ব সীমন্ত এলাকা কারাবাল্লা, ডোনা-মূলাগুল, লক্ষীপ্রসাদ হয়ে আসা ভারতীয় পণ্য নদীপথে কানাইঘাট খেওয়াঘাট দিয়ে সড়কে উঠানো হয়ে থাকে।
সম্প্রতি সিলেট-তামাবিল সড়কের হরিপুর বাজারস্থ চোরাচালান কেন্দ্রে সেনাবাহিনীর অভিযান জোরদার হওয়ায় সীমান্তের ওই তিন থানার সকল পণ্যই দরবস্ত কানাইঘাট হয়েই পাচার হচ্ছে। কানাইঘাট থানা সদর কেন্দ্রিক একটি চোরাচালানী সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই চোরাই পণ্যের সমাহার পাচার হচ্ছে। আর এ সিন্ডিকেটের, নেতৃত্বে রয়েছে কানাইঘাটের বায়মপুরের কুখ্যাত বুঙ্গাড়ী শিব্বির, থানার রামপুরের বুঙ্গাড়ী ছালেহ আহমদ ও পার্শ্ববতী জকিগঞ্জ থানার ঘাটের বাজারের বুঙ্গাড়ী সুমন মেম্বার উরফে ডেভিল সুমন। এই তিনজনই প্রশাসন সহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রন করেন। আর এইসব চোরাচালানের বখরা আদায়ের লাইনম্যানের দায়িত্ব পালন করেন কানাইঘাট থানার এএসআই মোজাম্মেল হোসেন রিপন। তার মাধ্যমেই চোরাকারবারিরা মূলত থানা পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় কিছু নামধারী সাংবাদিকদের ম্যানেজ করা হয়। এ বিষয়ে এএসআই মোজাম্মেল হোসন রিপনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি লাইনম্যান হওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, আমি থানার সেরেস্তা ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করি মাঠে আমার কোনো দায়িত্ব নেই।
এদিকে বর্তমান ওসি আব্দুল আউয়াল থানায় যোগদানের পর কানাইঘাট উপজেলায় ৮ মাসে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ খুন হন উপজেলার ৯নং রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের জামায়াতের শ্রমিক সংগঠনের নেতা তিন সন্তানের জনক হাফিজ শিহাব উদ্দিন (৪৫)। (ওসি) মো: আব্দুল আউয়াল ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থানায় যোগদান করেন। তার যোগদানের পর গত ৮ মাসে গড়ে প্রতিমাসে একটি খুনের ঘটনা ঘটে। এর আগে অনেকগুলো খুন সংগঠিত হলেও প্রকৃত আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় খুন যেনো ডাল-ভাতে রুপ নিয়েছে কানাইঘাট থানায়। স্থানীয় বিজিবি ও চোরাকারবারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের ৮০টি স্থান দিয়ে চোরাচালাণে পণ্য দেশে প্রবেশ করে। এসব পয়েন্ট দিয়ে গরু, মহিষ ছাড়াও চিনি, পেঁয়াজ, শাড়ি, থ্রিপিস, সানগøাস, প্রসাধনী সামগ্রী, চকলেট, গাড়ির যন্ত্রাংশ, চা পাতা, মোটরসাইকেলসহ ভারতীয় পণ্য চোরাই পথে বাংলাদেশে আনা হয়। এসবের মধ্যে অন্তত ১৫ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে পাচার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সীমান্ত হচ্ছে জৈন্তাপুরের ¤্রীপুর, আলুবাগান, ডিবির হাওর, মিনাটিলা, গোয়াবাড়ী, লালাখান। কানাইঘাটের সুরইহাট, সোনাতনপুঞ্জি। গোয়াইনঘাটের উৎমা, প্রতাপপুর, সোনাটিলা, আমস্বপ্ন ও সংগ্রামপুঞ্জি, নাম প্রকাশ না করার শর্তে কানাইঘাট সীমান্তের এক চোরাকারবারি জানিয়েছেন, ভারতীয় বিভিন্ন পণ্য বেশি আসে বাংলাদেশে, পাচার হয় কম। এর মধ্যে যেসব পণ্য ভারতে দাম বেশি এবং পাওয়া যায় না, সেগুলো বাংলাদেশ থেকে তারা নিতে আগ্রহী। তিনি জানান, সিলেট সীমান্ত এলাকার ওপারে আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী অনেক বাজার রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশি কিছু পণ্যের কদর বেশি। এর মধ্যে রসুন, স্থানীয় জাতের মাছ, সুপারি, শুঁটকি ও প্লাস্টিকের সামগ্রী অন্যতম। তিনি জানান, এক সময় প্রতিদিন ৩-৪ ট্রাক পণ্য যেত।


আরও পড়ুন