খাদ্য ভেজাল ও প্রতিকার
প্রকাশিত: ১৬-৯-২০২১ দুপুর ১২:২৪
বর্তমান সময়ে নাগরিক জীবনে উদ্বেগের প্রধান বিষয় হল খাদ্য ভেজাল। খাদ্য ভেজাল নাগরিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় অগ্রগতিকে করেছে বিপন্ন। তাই কবির ভাষায় বলা চলে — ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায় ;ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়।পঙক্তিদ্বয় অন্যসবক্ষেত্রে কতটা সত্য বলা কঠিন, তবে ভেজাল খাদ্যের ক্ষেত্রে একশত ভাগ সত্য।
খাদ্য ভেজাল বলতে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের নামে খাদ্যদ্রব্যে অসাধুভাবে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বা কেমিক্যাল, ক্ষতিকর কীটনাশকসহ অন্য কোন উপায়ে খাদ্যের মান ধরে রাখার অপচেষ্টাকে বোঝায়। যার ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় ভয়ানকসব দুরারোগ্য ব্যাধি অথবা শেষ পরিনতি মৃত্যু। সাধারণত কেমিক্যালসহ অন্যকোন উপায়েও যদি খাদ্যের মান ক্ষুন্ন হয় এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ হলে তাকে ভেজাল খাদ্য বলা হয়।
এক্ষেত্রে কিছু রাসায়নিক দ্রব্যের নাম চলে আসে যেগুলো খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে উপস্থিত থাকলে আমরা ঐ খাবারগুলোকে ভেজাল খাদ্য বলতে পারি।
এদের মধ্যে অন্যতম হলো কার্বাইড ,ফরমালিন , মনোসোডিয়াম, ইথোফেন। এছাড়াও চক পাউডার, ইউরিয়া ,মার্জারিন, পশুর চর্বি ,খনিজ তেল ,ন্যাপথলিন ,ডিডিটি, সাইক্লোমেট ,কাঠের গুঁড়ো, ইটের গুঁড়ো ও কম যায় না।
মাছ-মাংস ফলমূল-শাকসবজি তে সাধারণত ফরমালিন কার্বাইড বেশি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও নিত্যপণ্য সকল দ্রব্য এই ভেজালের আওতায় চলে এসেছে। মুড়ি, ডাল ,চাল, আটা -ময়দা ,দুগ্ধজাত পণ্য ,তেল ,চিনি এমন কিছুই আর বাকি নেই যাতে ভেজাল কোনো-না-কোনোভাবে প্রবেশ করে নাই।বলা হয়ে থাকে আমরা যা খাবার হিসেবে গ্রহণ করি তাই আমাদের দেহ গঠন করে ।তাহলে বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদন ও সচেতনতামূলক দিকনির্দেশনাসহ মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার ইনভাইরনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি কথা বলা যায়। ১৯৯৪ এ আমেরিকার ইনভাইরনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্যে যে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় তা ক্যান্সার কোষ গঠন করে। এক্ষেত্রে পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও একই কথা প্রকাশ করে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এর সমীক্ষায় দেখা গেছে ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রতিবছর ক্যান্সার ,কিডনির রোগ ,ডায়াবেটিসসহ অন্য আরও অসুখে প্রায়১৫ থেকে ২০ লক্ষ মানুষ অসুস্থ হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO)এর তথ্য অনুযায়ী দূষিত ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রায় প্রতি বছর ৬০ কোটির মত মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বিএসটিআই নির্ধারিত নীতিমালা এবং তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে কৃষি পণ্য এবং ভোগ্যদ্রব্যের মান আশানুরূপ নয় এবং এগুলোর মানোন্নয়ন যথাযথভাবে উন্নীত করা প্রয়োজন। আবার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষা করে জানতে পারে প্রায় ৫০ ভাগ খাদ্যে ভেজাল উপস্থিত।
তাহলে আমরা এখন বুঝতে পেরেছি কতটা ভয়াবহ অবস্থার শিকার আমাদের এই নাগরিক জীবন। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার রোগের কারণ এই ভেজাল খাদ্য। আর এর ক্ষতিকর প্রভাবের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে নবজাতক শিশু থেকে কৈশোর বয়সের যারা কিনা আগামী দেশকে দক্ষতার সাথে পরিচালনার ভার নিয়েছে। শিশুখাদ্য ও প্রাণ রক্ষাকারী ঔষধ ও এখন ভেজালের আওতায়। কবির সাহিত্য যেন তাই মন্থর গতি পেয়েছে। "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে "—এ কথাটার ব্যঙ্গাত্মক বিপরীত রূপ, খাদ্য ভেজাল আমাদের জীবনে যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে তার প্রতিফলন ঘটায়।
খাদ্য ভেজাল রোধে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ সুদূর অতীত থেকেই গ্রহণ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা এ বিষয়ে তৎপর। তবুও অর্থ লালসা, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার অভাব ,অসচেতনতা ,সুষম বন্টন ও সংরক্ষণের অভাব ছাড়াও অসংখ্য কারণ রয়েছে যার ফলে খাদ্যে ভেজাল রোধে আশানুরূপ ফল লাভ করা সম্ভব হয়নি।দেশের বিভিন্ন আইন বিভিন্ন সময়ে করা হলেও তার প্রয়োগ সুষ্ঠুভাবে করা হয়নি। "নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩"এর অধীনে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ২০ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য আইনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভোক্তা অধিকার আইন, ২০০৯ ;ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ,২০১৫ ;বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ,১৯৫৯; বিশুদ্ধ খাদ্য নীতিমালা, ১৯৬৭; ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ,২০০৯; পয়জনস আইন, ১৯১৯; ও বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪। এ সকল আইন সহ বিভিন্ন আদালত ও ট্রাইবুনাল খাদ্য ভেজাল রোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এছাড়াও খাদ্য ভেজাল রোধে ১৯৭৪ এর বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত খাদ্য ভেজাল রোধে গুরুতর শাস্তি প্রয়োগ করা হয়নি যদিও সেগুলো বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।মূলত সামান্য কিছু নামমাত্র জরিমানা এবং দু - এক মাসের কারাদণ্ড নিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
বিএসটিআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী খাদ্য ভেজাল রোধে কঠোর নীতিমালার সাথে সাথে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বর্ধিত করা এক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলাফল বয়ে আনবে।অবশেষে বলা চলে কঠোর নীতিমালা,প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং বিচারিক কার্যক্রম ছাড়াওজনসচেতনতা ,সুশিক্ষা ,সুষম বন্টন ও খাদ্যদ্রব্যের নিরাপদ সংরক্ষণ খাদ্যে ভেজাল রোধে আশানুরূপ ফল এনে দিতে পারে।
মনিশ বিশ্বাস
শিক্ষার্থী, আইনবিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।