আধ্যাত্মিক লোকসংগীতের সাধক খোয়াজ মিয়া আর নেই
প্রকাশিত: ২৬-৬-২০২৫ বিকাল ৫:৫৪
সিলেটের গৌরব, কিংবদন্তি গীতিকার ও সুরকার খোয়াজ মিয়া আর নেই। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
বাংলার লোকসংগীত অঙ্গনে খোয়াজ মিয়া ছিলেন এক অনন্য নাম। ‘লাগাইয়া পিরিতের ডুরি, আলগা থাইকা টানেরে’ কিংবা ‘আমার বাড়ি আয় রে বন্ধু’— এমন বহু জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। তাঁর গানে প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, মানবতা এবং সমাজচেতনার গভীর ছাপ ছিল। বাংলা লোকসংগীতের ইতিহাসে তিনি ছিলেন এক মরমি সাধক, যিনি গানকে করেছেন আত্মার অভিব্যক্তি।
১৯৪২ সালের ১২ মার্চ সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে খোয়াজ মিয়ার জন্ম। পিতা মৌলভী আজিজুর রহমান ও মাতা আছতুরা বিবির ঘরে জন্ম নেওয়া খোয়াজ শৈশব থেকেই ছিলেন সংগীতপ্রেমী। পড়াশোনার চেয়ে বাঁশি বাজানো ও গান গাওয়ার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবল। পরিবার থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তিনি গ্রাম-গঞ্জে গান গেয়ে বেড়াতেন। ১৯৬২ সালে তিনি বিখ্যাত মরমি সাধক দুর্বিন শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং গানের মধ্যে আধ্যাত্মিক দর্শন ও মানবতাবাদী বার্তা তুলে ধরতে শুরু করেন।
ডলি সায়ন্তনী, শিমুল খান, সাজ্জাদ নূরসহ দেশের নামকরা শিল্পীরা তাঁর লেখা গান গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁর অনেক গানই অ্যালবামের শিরোনাম হয়েছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে সফরের সময় তিনি লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে প্রবাসী বাঙালিদের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন। সেই সফরে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পান।
ব্যক্তিজীবনে খোয়াজ মিয়া ছিলেন নিঃসঙ্গ ও বেদনাবিধুর। তিনবার বিয়ে করলেও কোনও সংসারেই তিনি স্থিত হতে পারেননি। তাঁর প্রথম স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারান, দ্বিতীয় স্ত্রী অকালপ্রয়াত হন, তৃতীয় স্ত্রী চার সন্তান জন্ম দিলেও শেষ বয়সে তিনি ছিলেন একা। নয় সন্তানের পিতা খোয়াজ মিয়া সংগীতকেই নিজের জীবনের অবলম্বন করে তুলেছিলেন।
তাঁর মৃত্যুতে বাংলা লোকসংগীত এক অসামান্য সাধককে হারাল। এখন সময় এসেছে তাঁর লেখা ও সুর সংরক্ষণের, একটি সংগীত আর্কাইভ গড়ে তোলার এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে সম্মান জানানোর। নতুন প্রজন্মকে তাঁর আধ্যাত্মিক সংগীত দর্শনের সঙ্গে পরিচিত করা সময়ের দাবি।
খোয়াজ মিয়া ছিলেন এমন একজন স্রষ্টা, যিনি লোকগানের পরতে পরতে মানুষের আত্মার গল্প বলেছেন। সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে গানের পেছনে ছুটেছেন আজীবন। তাঁর সৃষ্টি বেঁচে থাকবে যুগের পর যুগ, যেমন বেঁচে থাকবে তাঁর গানে বাঁধা বাংলার প্রাণ-জীবন ও আত্মার প্রতিচ্ছবি।