বিএনপির সদস্য নবায়ন
নেতাকর্মীদের অংশগ্রহনে জনসভায় পরিনত
প্রকাশিত: ২৩-৬-২০২৫ বিকাল ৫:৩৫
প্রায় আট বছর বন্ধ থাকার পরে সদস্যপদ নবায়নের কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল (বিএনপি)। প্রথম ধাপে দীর্ঘ ১৬ বছরের পরীক্ষিত পুরোনো সদস্যদের নির্ধারিত মাসিক চাঁদা পরিশোধের মাধ্যমে তাদের পদ নবায়ন হবে। নবায়নের কাজ শেষ হলেই দ্বিতীয় ধাপে শুরু হবে নতুন সদস্য সংগ্রহের অভিযান। সেখানে অগ্রাধিকার পাবে তরুণ প্রজন্ম। তবে এবারও দলীয় চাঁদা যাদের বকেয়া থাকবে, তারা আগামী দিনে দলীয় মনোনয়নের জন্য বিবেচিত হবেন না। দলটির একাধিক নেতা আলাপকালে জানিয়েছেন এসব কথা।
জানা গেছে, গত সোমবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর গুলশান অফিসে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মাসিক চাঁদা পরিশোধ ও ফরম স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সদস্যপদ নবায়ন কার্যক্রম। এরপর স্থায়ী কমিটির সদস্যরা পদ নবায়ন করেন। এরপর মহানগর ও জেলা পর্যায়ে প্রাথমিক সদস্যপদ নবায়নের ফরম পাঠানো হয়। সদস্যপদ নবায়নের পর নেতা-কর্মীদের ডেটাবেজ তৈরি করা হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় সারা বংলাদেশের ন্যায় ঝালকাঠি জেলা, উপজেলা সদস্য পদ নবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়। এতে ঝালকাঠি সদর, রাজাপুর, কাঠালিয়া, নলসিটি এই কর্যক্রম চলে। এর মধ্যে সবার আগে কাঠালিয়া উপজেলার প্রথমিক সদস্য পদ নবায়ন কার্যক্রম শেষ হয়।এই উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নে সকল নেতাকর্মীদের স্বত:ফূর্ত আংশগ্রহনে সদস্য নাবায়ন পরিনত হয় জনসভায়।
গত ৯ জুন সোমবার বিকেল ৩টায় উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে কর্যক্রমের উদ্বোধন হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দল কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভানেত্রী জীবা আমিনা আল গাজী। বিশেষ অতিথি ছিলেন নিউইয়র্ক মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি সেলিম রেজা, বিএনপি নেতা কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সেচ্ছাসেবক দল মোঃ রফিক হাওলাদার, তরুণ দল কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ড. জাকারিয়া লিংকন, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আজম সৈকত, ঝালকাঠি জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি টিপু সুলতান, মহিলা দল ঝালকাঠি জেলার সভানেত্রী মতিয়া মাহফুজ জুয়েল, রাজাপুর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট নুর হোসেন প্রমুখ।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কাঁঠালিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি জাকির হোসেন কিসলু সিকদার, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম খোকন, সাবেক সহ-সভাপতি মজিবুল হক পান্না গোলদার, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক ফুল মিয়া, যুবদল নেতা রেজাউল করিম, রাজাপুর সদর ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মতিউর রহমান টুকু মৃধা, সেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মোঃ বাদল হাওলাদার, শ্রমিক দল নেতা মো. পান্না মুন্সী, মহিলা দল নেত্রী লীনা পারভীন।
এছাড়াও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ১ নং চেচরীরামপুর ইউনিয়নের বিএনপি নেতা আ. মান্নান মেম্বার, ২ নং পাটিখালঘাটা ইউনিয়নের ইসমাইল হোসেন কামাল মাস্টার, ৩ নং আমুয়া ইউনিয়নের ফজলে খোদা সুমন খলিফা, ৪ নং কাঁঠালিয়া সদর ইউনিয়নের হালিম সিকদার, ৫ নং শোলজালিয়া ইউনিয়নের মোজাম্মেল হক মোল্লা, ও ৬ নং আওরাবুনিয়া ইউনিয়নের জিয়াউর রহমান ইলিয়াস কাজী।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে এই সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেতৃবৃন্দ আগামী দিনের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানান এবং দলীয় ঐক্য ও সাংগঠনিক দৃঢ়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ বিষয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘সদস্যপদ নবায়ন একটি সাংগঠনিক কাজ। দীর্ঘ ১৬ বছর নেতা-কর্মীরা মামলা-হামলায় জর্জরিত ছিলেন। বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের সদস্যপদ নবায়ন করা হবে।এতে নেতা-কর্মীরাও নতুনভাবে উজ্জীবিত হবে।’ এরপর পর্যায়ক্রমে সকল ইউনিয়নের সদস্য নবায়ন কাজের শেষ হয়।
দলীয় সূত্রমতে, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মাসিক চাঁদার পরিমাণ ২ হাজার টাকা। ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের ৫০০ টাকা, যুগ্ম মহাসচিবদের ৩০০ টাকা এবং সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর মাসিক চাঁদা দিয়ে পদ নবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া যারা দলের প্রাথমিক সদস্য তারা বার্ষিক ১০ টাকা বা স্বেচ্ছায় যেকোনো পরিমাণ চাঁদা দিয়ে সদস্যপদ নবায়ন করবেন। তবে এবার মাসিক চাঁদার পরিমাণ বাড়তে পারে। যারা দলের গণতন্ত্র মোতাবেক নির্ধারিত মাসিক চাঁদা পরিশোধ করবেন না, যাদের আগের বকেয়া থাকবে তাদের আগামী দিনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। দলীয়ভাবে এটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, সদস্যপদ নবায়নের পরই শুরু হবে বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ। বিশেষ করে ১৮ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে কোটির বেশি নতুন সদস্যের খোঁজে অভিযান শুরু করবে বিএনপি। দলের গঠনতন্ত্রের ৫-এর ‘ক’ ধারায় বলা আছে, ১৮ বছর বা ততধিক বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক বিএনপি দলের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন। ১০ টাকার বিনিময়ে দলের সদস্য ফরম নিতে পারবেন। তবে নতুন সদস্য সংগ্রহে যাচাই-বাছাইয়ে কঠোরনীতি অবলম্বন করবে বিএনপি। কারণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সবাই এখন বিএনপিতে যোগ দিতে চাইছেন। বিশেষ করে কোনো দলের পদধারী নেতা ও কর্মী বিএনপিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাবেন না।
তাদের দাবি, দেশের অধিকাংশ মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করেন। বিশেষ করে তরুণ শ্রেণির অনেকেরই রাজনীতিতে আসার আগ্রহ আছে। কিন্তু গত সাত-আট বছর নতুন কোনো সদস্য সংগ্রহ করেনি বিএনপি। আন্দোলন-সংগ্রামে আসা তৃণমূল পর্যায়ের অনেকেই জানেন না তারা বিএনপির কর্মী কি না। এ জন্য সদস্যপদ নবায়নের সঙ্গে নতুন করে দলের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে বিএনপির দপ্তর বলছে, ২০১৭ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় দপ্তর, জেলা ও মহানগর থেকে অসংখ্য মানুষ সদস্য ফরম সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মী মারা গেছেন। যে কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। এবার সদস্যপদ নবায়নের পরই নেতা-কর্মীদের ছবিসহ নাম-পরিচয়, মোবাইল নম্বর, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডসহ ডেটাবেজ আপডেট করা হবে। এর আগে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে বিএনপির একটি ডেটাবেজ গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ করে দলটি। পরে ২০১৯ সালের অক্টোবরে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহের নামে ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেয় বিএনপি।
সারা দেশে দলটির জেলা, পৌরসভা, উপজেলা ও ওয়ার্ড কমিটি মিলিয়ে নেতা-কর্মীর সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। এই হিসাব তারা দিচ্ছেন বিএনপিসহ ১১টি অঙ্গসংগঠনের ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কাঠামোর কমিটি ধরে। তবে ন্যূনতম ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ধরে হিসাব করলে বিএনপির নেতা-কর্মীর সংখ্যা পৌনে দুই কোটির কিছু বেশি দাঁড়ায়। ১১টির মধ্যে সব অঙ্গসংগঠনের কমিটি দেশের সব ইউনিটে নেই। গুরুত্বপূর্ণ সাতটি ইউনিটের কমিটি সর্বত্র রয়েছে। ৬৪টি জেলায় মোট ৮২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি রয়েছে বিএনপির। প্রতিটি সাংগঠনিক জেলায় ১১টি অঙ্গসংগঠনের কমিটি রয়েছে, যার প্রতিটিতে ১৫১ সদস্যের কমিটি থাকার কথা। কিন্তু এই সংখ্যা ন্যূনতম ৫১ সদস্য ধরলে শুধু বিএনপিরই নেতা-কর্মীর মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮০। আর ১১টি অঙ্গসংগঠনের হিসাবে ওই সংখ্যা হলো ৪৪ হাজার ৮৮০।
ন্যূনতম হিসাবে সারা দেশের ৪৯৫টি উপজেলায় ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির নেতা-কর্মীর সংখ্যা ২৫ হাজার ২৪৫ এবং গুরুত্বপূর্ণ ৭টি অঙ্গসংগঠনের কমিটিতে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭১৫ জন নেতা-কর্মী রয়েছেন। এর বাইরে ৩৫০টি পৌরসভার ৯টি করে ওয়ার্ডে মোট ৩ হাজার ১৫০টিতে কমিটি রয়েছে বিএনপির। ন্যূনতম ৫১ সদস্যবিশিষ্ট ধরলে বিএনপির নেতা-কর্মী রয়েছেন মোট ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৫০ জন। সব অঙ্গসংগঠনের এই হিসাবে দাঁড়ায় ১১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫ জন। তবে বিএনপি জানিয়েছে, পৌরসভাগুলোর প্রতিটি ইউনিটের ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিই রয়েছে। সেই হিসাবে ওই নেতা-কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।
বিএনপির দেওয়া তথ্যমতে, সারা দেশে দলটির ৪০ হাজার ৪৮২টি ওয়ার্ড কমিটিতে ন্যূনতম হিসাবে নেতা-কর্মীর সংখ্যা ১ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৪। এ ছাড়া সারা দেশে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইউনিয়ন কমিটিতে ২ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী রয়েছেন। ৭টি অঙ্গসংগঠন ধরলে এই সংখ্যা হবে মোট ১৬ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। এই হিসাব মূল বিএনপিসহ এর প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ ৭টি অঙ্গসংগঠনের ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ধরে। এর বাইরে বিএনপির অঙ্গসংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি রয়েছে জাতীয়তাবাদী ওলামা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, মৎস্যজীবী দল ও জাসাসের (জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন)। তবে এগুলোর সব জায়গায় কমিটি নেই।