নির্বাচনী ব্যবস্থায় গণমাধ্যম নীতিমালার প্রস্তাবিত সংস্কার ও গণমানুষের প্রত্যাশা

news paper

এস এম আকাশ

প্রকাশিত: ১৮-৬-২০২৫ দুপুর ৪:৫৬

205Views

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় গণমাধ্যম নীতিমালার পরিবর্তনের বিষয়টি সচেতন নাগরিকদের প্রথম ও অন্যতম দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে সকল বিতর্কিত নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার অপপ্রয়াস ছিল একটি সাধারণ বিষয়। যা না করলেই সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে ভীতি থেকেই যেত নির্বাচন কমিশনের কাছে। 
২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আয়োজিত সকল নির্বাচনে এ অপপ্রয়াস সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে নির্বাচন ও সংবাদ মাধ্যম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে প্রমোট করার জন্য ততসময়ের কমিশন বেসরকারি সংস্থাকে ব্যবহার করে গণমাধ্যমের কলম ও কন্ঠ রোধ করে রেখেছিল। ধারাবাহিক এসকল নির্বাচনের বিরোধিতায় কবি মাহবুব মোর্শেদের নেতৃত্বে সক্রিয় ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত কারণ শীর্ষক সংগঠনটি লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যায়। উক্ত সংগঠনের একটি গ্রুপ দেশের বিভিন্ন কথিত পর্যবেক্ষক সংস্থার মোর্চা এবং বিভিন্ন ফোরামের পক্ষে কাজ করে নানান অভিজ্ঞতা ও তথ্য সংরক্ষণ করেছে এবং প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জনতার পক্ষে হাজারো উদাহরণ একাট্টা করেছে এবং মুক্ত বাংলাদেশের জন্য উন্মোচনের দ্বার প্রান্তে এসে গনতন্ত্র চর্চায় আত্ম নিয়োগ করছে।

গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ প্রশ্নে প্রথমেই আলোচনায় এসে যায় ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন প্রসঙ্গ। এ নির্বাচনে ততকালীন সরকারের চাহিদা অনুযায়ী কমিশন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারে নানাভাবে পথ রোধ করার চেষ্টা ও কৌশল সৃষ্টি করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সকল প্রার্থীকে সংবাদ মাধ্যমে কথা বলার রুট ম্যাপ করে দেয়া। এর পরে ২০১৫ সালের ৩০ মে মাগুরা-১ আসনে উপ নির্বাচনে একসঙ্গে অনেক সাংবাদিকরা ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে। এর প্রেক্ষিতে কাজে বিঘ্ন ঘটার অজুহাতে একসঙ্গে পাঁচজন সাংবাদিক প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করে ততকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। ঐ কমিশন তখন ৯ দফা দিয়ে একতরফা এক নির্দেশনায় জানান যে,দশ মিনিটের বেশি সময় কোনো সাংবাদিক ভোট কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারবে না। এই পরিপত্রের প্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪০ টিরও বেশি ভোট কেন্দ্রে অনুমোদিত সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া সহ নানান নাজেহালের ঘটনা ঘটে। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন একাধিক সাংবাদিক একসঙ্গে একই ভোটকক্ষে ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা। সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারে বাঁধা। স্টিকার না দেওয়া। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে অবহিত না করে ভোটগ্রহণ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ। ছবি তোলা এবং ভিডিও ধারণ করার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কমিশন থেকে বলা হয়েছিল ভোট কেন্দ্রের ভেতর থেকে নয় বরং ভোট কেন্দ্র ও কক্ষ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সংবাদ সংগ্রহ ও সরাসরি সংবাদ সম্প্রচার করাসহ বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে। জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে স্বাধীন ও গনতান্ত্রিক দেশে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে এসব একমূখী বিধি-নিষেধ গুলো ছিল একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিরাট বাধা। পরিবেশ টা এমন ছিল যে,তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব সাংবাদিকদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এভাবে আখ্যায়িত হওয়ার পরেও দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও অদৃশ্য কারণে সবাই চুপ ছিলেন। পর্যায়ক্রমে গণমাধ্যমকে দমিয়ে রাখার জন্য কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন একটি সাংবাদিক নীতিমালা জারি করে। এ নীতিমালায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার বন্ধ,প্রিজাইডিং অফিসারকে অবহিত না করে ভোটগ্রহণ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ না করা,ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণ না করা,রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে রেখে পছন্দের সংবাদ মাধ্যম গুলো প্রথম বিবেচনায় এনে নির্ধারিত সংখ্যক সাংবাদিককে অনুমোদন ও পাস কার্ড ইস্যু করতে পারার ক্ষমতা প্রদান। ১০ মিনিটের বেশি ভোটকক্ষে অবস্থান করতে না দেওয়া এবং ভোটকক্ষ থেকে কোনো ভাবেই সরাসরি কিংবা ভিডিও রেকর্ড ও ছবি তুলতে না দেওয়া সহ অতিরিক্ত বিধান যুক্ত করা হয়। এসমস্ত বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সুজন ও টিআইবি সহ বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ করার পরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে উক্ত নীতিমালায় সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হলেও বিদ্যমান নীতিমালায় অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভূমিকা পালনে প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়। 

এমনই প্রশ্নবিদ্ধ নীতিমালা পরিবর্তনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বিশিষ্ট নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং সুশাসনের জন্য নগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড.বদিউল আলম মজুমদার কে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান করে আট সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে। গত ১লা ফেব্রুয়ারী ২০২৫ তারিখে দাখিলকৃত প্রস্তাবনায় উক্ত কমিশন গণমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকায় বিদ্যমান নীতিমালায় সংস্কার প্রেক্ষিত সংশোধন করে বেশ কিছু ধারা ও বিধান বাদ দিয়ে সুপারিশ প্রস্তাবনা দিয়েছেন। এতে ভোট গ্রহণে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব গুলো হলো:
১) নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রদত্ত বৈধ কার্ডধারী বা পাসধরী সাংবাদিক সরাসরি ভোট কেন্দ্রে কারোরই কোন প্রকার অনুমতি না নিয়েই প্রবেশ করতে পারবেন। অর্থাৎ নতুন করে কারো কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে না। 
২) কোনো রকম অনুমতি ছাড়াই ভোটগ্রহণ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ,ছবি তোলা এবং ভিডিও ধারণ করতে পারবেন,তবে কোনোক্রমেই গোপন কক্ষের ভেতরের ছবি ধারণ করতে পারবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, গোপন কক্ষে কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটলে সে ছবি/ভিডিও ধারণ করতে পারবেন।
৩) একটি ভোটকক্ষে একসঙ্গে একটি গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার প্রবেশ করতে পারবেন। তবে বিশেষ কারণে যেমন; বিশিষ্ট ব্যক্তির ভোট প্রদানের ছবি তুলতে/ভিডিও ধারণ করতে,কিংবা অনিয়মের ছবি তুলতে/ভিডিও ধারণ করতে একাধিক সাংবাদিক একসঙ্গে ভোটকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন।
৪) সাংবাদিকগণ ভোটগণনা কক্ষে ভোট গণনা দেখতে পারবেন,ছবি নিতে পারবেন। শুধুমাত্র সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন না। তবে শর্ত থাকে যে,গণনার সময় কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটলে তা সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন।
৫) গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে অনুমোদিত সকল শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত ও বৈধ স্বকৃীত সংবাদ কর্মীরা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন থেকে স্ব স্ব প্রমাণ পত্র দাখিল করে বিশেষ পাস কার্ড গ্রহণ করতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ থাকবে না। 
উপরোক্ত সকল বিষয় গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিগত বছরগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে পূর্বের প্রায় সবকটি নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। যার দরুন স্বাধীন দেশে জাতির বিবেকের ভূমিকায় থাকা শক্তিশালী প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব থেকে দেশের সকল গণমাধ্যম গুলোর বাকস্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় পুরোপুরি ব্যার্থ ছিল। যেখানে জনগণের ভোট উৎসবের তথ্য জনগণের কাছে সঠিক ভাবে পৌঁছে দিতে গণমাধ্যম অবরুদ্ধ থাকে সেখানে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমালোচনার ঝড় উঠবেই। তাই আনিত সংস্কার প্রস্তাবনা গুলো সঠিক ভাবে প্রয়োগ হলে বাংলাদেশের মানুষ নৈতিক সাংবাদিকতার উপর শতভাগ আস্থা রাখতে পারবেন। একই সাথে গণমাধ্যম কর্মীরা জাতির বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব পূণরায় ফিরে পাবে।

লেখক:
গণমাধ্যম কর্মী ও নির্বাচন বিশ্লেষক। 


আরও পড়ুন