বিলুপ্তির পথে পরিবেশ-বন্ধু গুইসাপ
প্রকাশিত: ১৬-৬-২০২৫ দুপুর ১:২২
আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে অতি পরিচিত পরিবেশ বন্ধু উপকারী প্রাণী গুইসাপ। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এদের অবদান অতুলনীয়। এক সময়ে বাংলার প্রকৃতি জুড়ে এদের প্রায়ই দেখা গেলেও মানব সৃষ্ট নানা কারণে বর্তমানে বিপন্নপ্রায় সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী গুইসাপ।
একসময়ে গ্রাম বাংলার বনজঙ্গল, ঝোপঝাড় ও কৃষি জমিতে প্রায়ই গুইসাপের দেখা মিলতো। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই প্রাণীটির অবদান সবচেয়ে বেশি। গুইসাপ! নামের পাশে সাপ শব্দ থাকলেও গুইসাপ আসলে সাপ নয়। এরা মূলত টিকটিকি জাতীয় সরীসৃপ প্রাণী এবং এর কোনো বিষ নেই। বিষধর সাপ, সাপের ডিম ও ক্ষতিকর পোকামাকড় এদের প্রিয় খাদ্য। এগুলো খেয়ে প্রাণীটি আমাদের উপকার করে। ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফেলার কারণে ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু প্রকৃতি থেকে এদের আবাসস্থানগুলো আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে না পেরে প্রকৃতি থেকে গুইসাপ আজ বিলুপ্তির পথে।
সরেজমিনে উপজেলা সদরসহ সাহতা, বাউসী, রায়পুর, চিরাম, সিংধা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ও বয়ষ্কদের সাথে কথা বললে তারা জানান, একসময়ে গ্রামাঞ্চলে বাড়ি আশেপাশের বনজঙ্গল, ঝোপঝাড় ও ফসলের জমিতে প্রতিদিনই গুইসাপের দেখা মিলতো। গুইসাপ বিষাক্ত সাপ ও সাপের ডিম খেয়ে ফেলে তাই আগে সাপের উপদ্রব এতো বেশি ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পুরানো কিছু গুইসাপ ছাড়া বাচ্চা গুইসাপ চোখে পড়ে না বললেই চলে। দিন দিন প্রকৃতি থেকে গুইসাপের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলেই এদের প্রধান খাদ্য পোকামাকড়রে সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, ইদুরের উৎপাত বৃদ্ধিসহ অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে বিষাক্ত সাপের। যা আমাদের পরিবেশ ও মানুষের জন্য মোটেও সুখকর নয়।
বারহাট্টা সরকারি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রভাষক মজিবুল হকের সাথে কথা বললে তিনি জানান, গুইসাপ বা গোসাপ এর বৈজ্ঞানিক নাম 'ভারানাস স্যালভেটর', ইংরেজি নাম- Monitor Lizard। প্রকৃতপক্ষে কোন সাপ নয়, এরা টিকটিকি গোত্রীয় প্রাণী। এরা বড়সড় টিকটিকির মতো দেখতে কিন্তু সাপের মতো দ্বিখণ্ডিত জিভ সম্পন্ন সরীসৃপ প্রাণী। এরা ভ্যারানিডি (Varanidae) গোত্রের সরীসৃপ প্রাণী। 'গুই'/ 'গো' নামটি এসেছে “গোধিকা” থেকে। এরা ১০-১১ ফুট লম্বা হতে পারে। তবে গড় দৈর্ঘ্য ৪ ফুট ১১ ইঞ্চির মতো। ওজন ২৫ কেজির মতো হতে পারে। তবে বেশির ভাগেরই ওজন এর অর্ধেক। বড় গুই দেখতে গাঢ় বাদামি বা কালচে, তাতে হলুদ রঙের রিং দৃশ্যমান। এটি খুব শক্তিশালী প্রাণী। পা ও নখ লম্বাটে, লেজ চ্যাপ্টা। কিন্তু এর চামড়া সাদা নয়। তড়িৎ গতিতে এরা খাল-বিল, পুকুর ও জলাশয়ে সাঁতার কেটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে ৩ ধরনের গুইসাপ দেখা যায় (কালো গুই, বড় গুই বা রামগদি গুই এবং সোনা গুই বা হলদে গুই)। লম্বা আকারের এই সাপের দেহ আঁশে ঢাকা থাকে। এদের শক্তিশালী লেজ পানিতে সাতার কাটতে ও শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। আর চোখের দুই পাশে দুই পর্দা শ্রবণ ইন্দিয়ের কাজ করে। ডাঙ্গায় দ্রুত দৌড়ানোর জন্য আছে মজবুত পা। প্রয়োজন হলে এরা গাছেও উঠতে পারে। গাছে উঠার জন্য এদের তীক্ষ্ণ ও মজবুত নখ আছে। গুইসাপ মাংসাশী প্রাণী। এরা দিবাচর বলে দিনের বেলা খাদ্য গ্রহণ করে আর রাতের বেলা বিশ্রাম নেয়। গুইসাপ মরা ও পচা প্রাণী খেয়ে পরিবেশ দূষণ রোধ করে। গুইসাপ বিষধর সাপ ও ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে৷ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুইসাপের ভূমিকা অতূলনীয়৷ এরা খাদ্যশৃঙ্খলে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এ বিষয়ে বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক কালেরকন্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, গুইসাপ নিরীহ প্রকৃতির প্রাণী হওয়ায় মানুষ দেখলেই পালিয়ে যায়। এ প্রাণী আমাদের কোনো ক্ষতিসাধন করে না। বরং উচ্ছিষ্ট ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপের ডিম খেয়ে এরা সেই সাপগুলোর সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে। গুইসাপ পরিবেশের জন্য একটি উপকারী প্রাণী। এ উপকারী প্রাণীটিকে বিষাক্ত মনে করে নিধন করা ঠিক নয়। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় গুইসাপ সংরক্ষণ করা জরুরি। না হয় পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ সাদিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে গুইসাপের তিনটি প্রজাতি কোনরকমে টিকে থাকলেও, কিছু লোক বিচিত্র এই প্রাণী বিলীন করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রাণীটি সংরক্ষিত হলেও, অতিমূল্যবান চামড়ার জন্যেই নিধন করা হচ্ছে এদের। সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরেও থামছেনা গুইসাপের চামড়া পাচার। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণেই এই উপকারী প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে।