রাস্তা নেই, স্কুল নেই, হাসপাতালও নেই তবুও বেঁচে থাকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের মানুষ
প্রকাশিত: ১৪-৬-২০২৫ দুপুর ১:৪১
যেখানে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে রাষ্ট্র গর্ব করে, সেখানেই গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ঘেঁষা কাবিলপুর, কালাসোনা চর, খাটিয়া মাড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পড়ে আছে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি ও উন্নয়নের আলোকছায়ার বাইরে। নেই পাকা রাস্তা, মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা আধুনিক চিকিৎসাসেবা; তবুও এখানকার মানুষ প্রতিদিন টিকে আছেন শুধুমাত্র সাহস, প্রাকৃতিক সহনশীলতা এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে।
ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাস ও বিচ্ছিন্নতাই যেন এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। বর্ষায় নদীর প্রবল স্রোত ভেঙে নেয় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি এমনকি স্বপ্নও। শুষ্ক মৌসুমে সেই নদীই হয়ে দাঁড়ায় যাতায়াতের অন্তহীন বাধা। ওপারে আছে স্কুল, হাসপাতাল, হাট—আর এপারে কেবল অনিশ্চয়তা।
কাবিলপুর চরের বাসিন্দা মফিজল মিয়া বলেন, "আমার জীবনেই চারবার ভাঙনের শিকার হইছি। বাড়ি ভাঙছে, জমি ভাঙছে। যা আছে, কোনদিন থাকে কোনদিন যায়, জানি না।"
এখানে নেই কোনো পাকা রাস্তা। বর্ষায় চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রোগী হলে খাটিয়া বয়ে, নৌকায় বা বাঁশের ভেলায় করে নদী পার করতে হয়। এতে প্রায়শই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
টেংড়াকান্দি চরের নাজমা বেগম জানান,"হাসপাতাল অনেক দূরে। সন্তান জন্মের সময় গ্রামের এক দাই আসে আরেক চর হতে। জটিলতা হলে মায়েরা বাঁচে না। কয়েক বছর আগে এক গর্ভবতী বোন নৌকায় মারা গেছে।"
এই গ্রামে একটি পুরোনো টিনের চালা মাদ্রাসা ছাড়া শিক্ষার কোনো সুব্যবস্থা নেই। শিশুদের অনেক দূরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয় নদী পার হয়ে।
গুণগুড়ি দি মুখে উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আসিফ জানায়,"স্কুলে যেতে সকালবেলা নৌকা লাগে। নদী যদি রাগ করে, তাহলে ক্লাস বন্ধ। শুকনো মৌসুমে ৫-৬ কিলোমিটার বালুচর পেরিয়ে যেতে হয় ওপারের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এ জন্য অনেকে স্কুল ছেড়ে দেয়।"
বিশ্বাস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ওয়াহেদুজ্জামান বিশ্বাস তোহা বলেন,"ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষ প্রতিদিন এক যুদ্ধ করে বেঁচে থাকেন। তাদের এই লড়াই জীবনের মৌলিক অধিকার রক্ষার লড়াই।"
এ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও করুণ। সাধারণ রোগেও মানুষ কবিরাজ বা ওঝার শরণাপন্ন হন। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নৌকা করে উপজেলা শহরে যেতে হয়, যা বর্ষায় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ফুলছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা হাসমত আলী বলেন,"আমরা শুধু নদী পাড়ের মানুষ না, দ্বিগুণ বঞ্চনার শিকার। ভোট দিই, কর দিই, কিন্তু পাওয়ার বেলায় শূন্য হাতে ফিরে আসি। সরকার কথা বলে, কাজের বেলায় কেউ আসে না।"
ফজলুপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মুক্তার হোসেন বলেন,"বারবার প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দিলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এখানে ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ ও অর্থসংকটের কথা বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।"
ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জগৎবন্ধু মণ্ডল জানান,"এ অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে নদীভাঙন ও দুর্যোগ প্রবণতার কারণে কাজ কিছুটা সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ছে।"
রাষ্ট্র যখন মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভার নিয়ে গর্ব করে, তখন ব্রহ্মপুত্র পাড়ের এই মানুষেরা তাকিয়ে থাকে শুধু একটা রাস্তা, একটা স্কুল আর একটা হাসপাতালের স্বপ্ন নিয়ে।
একটি প্রবাদ আছে— নদীর পানি যেমন ভয়ংকর, তেমনি জীবনদায়ীও। ব্রহ্মপুত্র যেন এখানকার মানুষের জীবনের প্রতীক—যা ধ্বংসও করে, আবার বেঁচেও রাখে।