ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শীতল পাটির শীতল পরশ
প্রকাশিত: ৭-৫-২০২৫ দুপুর ৩:৪৭
গ্রামবাংলার শত বছরের ঐহিত্য শীতল পাটি। গরমে প্রশান্তির পরশ পেতে শীতল পাটির জুড়ি নেই। শীতল পাটি বাংলার সুপ্রাচীন এক কুটির শিল্পের নাম। শীতল পাটি আমাদের বাঙালি সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ। অথচ আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং প্লাস্টিক ও মেশিনে তৈরি পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে।
'মধুর চেয়ে আছে মধুর; সে এই আমার দেশের মাটি; আমার দেশের পথের ধূলা, খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি। চন্দনেরি গন্ধভরা, শীতল করা, ক্লান্তি-হরা; যেখানে তার অঙ্গ রাখি- সেখানটিতেই শীতল পাটি।' বাংলা সাহিত্যের ছন্দবাজ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'খাটি সোনা' কবিতায় শীতল পাটির স্পর্শ মেলে। যুগ যুগ ধরে আবহমান গ্রাম-বাংলায় শীতল পাটির কদরও ছিল আলাদা। গরমের দিনে ঘুমাতে আরাম বলে এই পাটিকে সবাই শীতল পাটি নামেই চেনেন। একসময়ে গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়ির আঙিনায় সুপারি কিংবা আম-কাঁঠাল বাগানের ছায়ায় শীতল পাটিতে পিঠ এলিয়ে একটুখানি স্বস্থির কথা বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে জন্মগ্রহণ করা সকলের অবশ্যই জানা আছে। শীতলপাটি গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। একসময়ে গ্রাম কিংবা শহরের সৌখিন মানুষদের কাছে শীতল পাটির কদর ছিল অনেক। তবে বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার দাপটে উন্নত মানের মাদুর ও প্লাস্টিকের রেক্সিন আবিষ্কারের কারণে হ্রাস পেয়েছে শীতল পাটির মূল্য ও উৎপাদন। এছাড়াও শীতল পাটি তৈরির কাঁচামাল বেতের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরির পাশাপাশি পুঁজির অভাব এসব নানা কারণে সারা দেশের মতো বারহাট্টা থেকেও এখন বিলুপ্তির পথে হাজার বছরের ঐতিহ্যের এই হস্তশিল্প।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি পাড়ায় ঘুরে ও কয়েকজন করিগরের সাথে কথা বললে তারা জানান, আগে পাটি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে যা রোজগার হতো তা দিয়ে তাদের সংসার চলতো। এখন কেউ আর আগের মতো পাটি কিনতে চায় না। আগের তুলনায় বেত গাছের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। তাছাড়া পাটি বানানোর কাজ করতে সর্বনিম্ন তিন জনের প্রয়োজন হয়। কেউ পাটি বুনন করেন, কেউ বেত চাঁচেন আবার কেউ পাটিতে রং করেন। যারা পাটি বুনন করেন তাদের একেকজনকে ৩০০-৪০০ টাকা মজুরি দিতে হয়। তিনজন মিলে একটি পাটিতে কাজ করলে একেকটি ছোট পাটি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা, মাঝারি পাটিতে খরচ হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা এবং বড় পাটির জন্য খরচ ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ একেকটি পাটি তৈরিতে যে টাকা খরচ করতে হয় সেই দামে বাজারে পাটি বিক্রি করা সম্ভব হয় না।
পাখা বানানোর ব্যবসা বন্ধ করার কারণ জানতে উপজেলা সদরের কাশবন গ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী পাড়ার পাখা তৈরির কারিগর অসিত ক্ষত্রিয়, অবনী ক্ষত্রিয়, গুহিয়ালা গ্রামের নিলীমা ক্ষত্রিয়, নান্টু ক্ষত্রিয়, বাউসী ইউনিয়নের রামভদ্রপুর গ্রামের প্রতিমা সিংহ, তপন সিংহসহ কয়েজন পাটি তৈরির কারিগরের সাথে কথা বললে তারা জানান, শীতল পাটি তৈরির কাঁচামাল সংকট ও মুনাফা কম হওয়ায় অনেক কারিগর এই পেশা পাল্টে ফেলছেন। যারা এখনও এ পেশায় টিকে আছেন বর্তমানে তাদের অবস্থা ভালো নয়। কোনো রকমে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়তই তারা সংগ্রাম করছে চলছেন। আবার কেউ কেউ বাংলার বিভিন্ন উৎসবে হাজার বছরের ঐতিহ্যকে সম্বল করে মূর্তা নামক বেত দিয়ে তৈরি করছেন শীতল পাটি। তারা বলেন, সরকারী সহায়তা পেলে আমাদের এই পেশাকে আরো বড় করতে পারতাম। আমরা চাই প্রাচীন এই ঐতিহ্য টিকে থাকুক আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্প বাঁচাতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
উপজেলার সাহতা ইউনিয়নের বোয়ালী গ্রামের ৭০ বছর বয়সী মনিন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, আগে আমাদের মত কৃষকরা কাঠফাটা রোদে ফসলের মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে।প্রচন্ড গরম থেকে আরাম পেতে গাছের ছায়ায় শীতল পাটি বিছিয়ে ফুরফুরে বাতাসে গা হেলিয়ে দেহ-মনে প্রশান্তি পেতাম। কিন্তু এখন প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি পাটির ব্যবহারে এখন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শীতল পাটি তৈরি ও ব্যবহার।
উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের শাসনউড়া গ্রামের পাটি কারিগর সজল দেবনাথ পেশাগতভাবে শীতল ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে পাটি তৈরি ও বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। পেশাটি তার পারিবারিক পেশা। পাটি বানানো বাবার কাছ থেকে শিখেছেন। তিনি বলেন, একসময়ে একটি পাটি বিক্রি করতেন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায়।
তিনি বলেন, বর্তমানে শীতল পাটির কদর না থাকলেও পূর্ব পুরুষের পেশা ধরে রাখতে আমি এর আধুনিক রূপ দিয়েছি। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, তবে আমি শীতল পাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করেছি এবং অন্যদেরও উৎসাহ দিচ্ছি।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কালেরকন্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, শহুরে জীবনের ব্যয়বহুল ব্যস্ততা, প্লাস্টিকের আধিক্য, সাধ্যের বাইরে দামের কারণে শীতল পাটির কদর এখন আর নেই বললেই চলে। এর সুবিধা সম্পর্কে জানে না নতুন প্রজন্মও। কেউ তো কিনছেনই না, আগ্রহও হারিয়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ ধুঁকে ধুঁকে ব্যবসা চালিয়ে নিলেও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন বেশির ভাগ শিল্পীই। ফলে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে হাজার বছরের শিল্পটি।
বর্তমানে শীতল পাটির ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, মূর্তা বেতের অপ্রতুলতা, উপকরণ সামগ্রীর (বেত, রং, মূলধন) মূল্যবৃদ্ধি ও ভালো বিপণন কেন্দ্রের অভাব, এই শিল্পের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই শিল্প আবার নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেতে পারে।