কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে ঝাড়ুদার পাখি কাক
প্রকাশিত: ৬-৫-২০২৫ দুপুর ১১:৩৭
অতীতে গ্রামবাংলায় ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কাকের কা...কা...ডাকে মুখরিত হয়ে উঠতো গ্রামীণ জনপদ। মানুষের ঘুম ভাঙতো কাকের আওয়াজে। ভোরের আলো ফোটার আগেই কাকের ‘আড্ডা’ শুরু হয়ে যেত পাড়া-মহল্লার আঁস্তাকুড়ে। অথচ কালের বিবর্তনে শহর অথবা গ্রাম থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে অতি পরিচিত কাক।
বাংলা সাহিত্যে কালো এই পাখিটির মতো এত ব্যাপক উপস্থিতি অন্য কোনো পাখির নেই। 'গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই; গোঠে গরু নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরু; আল খাঁ-খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক; নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।' কবি শামসুর রহমানের 'কাক' কবিতায় গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত অন্যতম পাখি কাক। এক সময়ে শহর থেকে গ্রাম সবখানে ছিল যার রাজত্ব। তাইতো রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ 'আবার আসিব ফিরে' কবিতায় ভোরের কাক হয়ে বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। একসময়ে সারা দেশের মতো বারহাট্টা উপজেলার প্রতিটি গ্রামে কাকের বিচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। আঁকাবাঁকা পথের ধারে বৈদ্যুতিক তারে উপরে, বড় বড় গাছ ও টিনের চালায় হরহামেশাই কাকের দেখা মিলতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে- হঠাৎ কী হলো তার? তবে কি প্রকৃতি থেকে ক্রমেই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই অতি পরিচিত পাখিটি।
সপ্তাহ জুড়ে সরেজমিনে উপজেলা সদরসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা জানান,একসময়ে দেখা যেত, এক দল কাক খাবার নিয়ে হল্লা করছে তো আরেক দল রাস্তার পাশের বিদ্যুতের লাইন কিংবা টেলিফোনের তারে সারি বেঁধে বসে কা... কা... স্বরে আওয়াজ করছে। কখনো তারা আবার খাবারের সন্ধানে চুপিসারে ঢুকে পড়তো মানুষের ঘরে। কাকের সঙ্গে মানুষের নিত্যসম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন জুড়ে চারদিক এলোমেলো ভাবে ঘুরে মাতিয়ে রাখতো শহর কিংবা গ্রামীণ জনপদ।
উপজেলার মধ্য বাজার এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিমল সরকারেরর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, পাখির জগতে কাককে বুদ্ধিমান চতুর পাখি বলে মনে করা হয়। ‘কলসের মধ্যে পাথর ফেলে পানি ঠোঁটের নাগালে আনা’ কাকের বুদ্ধির একটি গল্প আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়েছি। কাক পোকামাকড়, ফলমূল, বড় বড় ফুলের মধু, ফসলের বীজ, পাখির ডিম, সাপ, ব্যাঙ ছাড়াও মরা ইঁদুর, বিড়াল, গরু, ছাগল, ভেড়াসহ বিভিন্ন পচা-বাসী খাবার খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এদের বৈশিষ্ট্য হলো- নোংরা, পচা-বাসী খাবার খেয়ে হজম করতে এদের কোনো বেগ পেতে হয় না। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এরা কখনো গোসল করা বাদ দেয় না। আর ঘরে ফেরার আগে নদী, পুকুর বা ডোবার কাছে গিয়ে পা, মাথা পরিষ্কার করে, ঠোঁট দিয়ে পানি তুলে পাখা ধোয়। নোংরা জিনিস খেলেও এরা শরীর নোংরা রাখে না।
তিনি আরও বলেন, এরা প্লাস্টিক, ফিতা, রশি, কাপড়ের টুকরা, উল, তুলা, লোহার তার, পলিথিন, গাছের শুকনো ডাল অর্থাৎ রাস্তায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত প্রায় সব কিছু দিয়েই অগোছালোভাবে বাসা বাঁধে। কাকের বাসার অগোছালো বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘কাকের বাসা’ বাগধারাটির উদ্ভব হয়েছে।
বারহাট্টা সরকারি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রভাষক মজিবুল হক জানান, কাক Passeriformes বর্গের Corvidae গোত্রের অন্তর্গত একজাতীয় কালো পাখি। পৃথিবীতে ৪০টিরও বেশি প্রজাতির কাক দেখা যায়। তবে আমাদের বাংলাদেশে সাধারণত দাঁড়কাক ও পাতিকাক এই দুই প্রকারের কাকই দেখা যায়। দাঁড়কাক (Jungle Crow) ঘোর কৃষ্ণ বর্ণে আচ্ছাদিত কাক। এরা আকারে বেশ বড় হয়। এদের ঠোঁট মোটা। এই কাকের বৈজ্ঞানিক নাম- Corvus macrorhynchos। এই বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বড় ঠোঁটের কাক। আর পাতিকাকের বৈজ্ঞানিক নাম-Corvus splendens। এরা আকারে দাঁড়কাকের তুলনায় বেশ ছোট হয়। আমরা আশপাশে যে কাক দেখি তার প্রায় সবই পাতিকাক। পাতিকাকের ঘাড়, গলা, পিঠ ও বুক ছাই রঙের আর লেজ, ডানা, মাথা কালো কুচকুচে। পাতিকাক সর্বভুক প্রাণী অর্থাৎ এরা সব খায়।
তিনি বলেন, কাকের প্রজনন ঋতু মূলত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত, তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর বিভিন্নতা দেখা যায়। কাক একবারে ৩-৬টি ডিম দেয়। ডিমের রং আকাশি, তার ওপর থাকে কালচে বাদামি ফোঁটা। ডিমের মোটা অংশে বাদামি ফোঁটার ঘনত্ব বেশি। স্ত্রী কাকই মূলত ডিমে তা দেয়। পুরুষ কাকও দেয়, তবে খুব কম সময়ের জন্য। তবে বৃষ্টি নামলে, শিলাবৃষ্টি হলে বা প্রচণ্ড রোদ পড়লে পুরুষ কাক স্ত্রী কাকের সঙ্গে ডিম আগলে রাখে। ১৬ থেকে ১৭ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বেশির ভাগ প্রজাতির কাকের আয়ুষ্কাল ১০-১৫ বছর।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কালেরকন্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদের সাথে কথা বললে তিনি সকালের সময়কে বলেন, কাকের সাথে মানুষের যে সখ্যতা আছে তা হয়তো আমাদের আলাদা করে নজর কাড়ে না। কখনও শীতের বিকেলে শিশুদের আনন্দের খোরাক হয় কাক। আবার কখনও প্রভাতে প্রবীণদের হাটার সঙ্গী হয় সে।
তিনি আরও বলেন, সাহসী পাখিদের মধ্যে অন্যতম পাখি কাক। কাকের রয়েছে সমাজতান্ত্রিক মনোভাব। কাক নিজ সমাজে সাম্যের কথা বলে। রয়েছে, তার সমাজ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা। একটি কাক বিপদে পড়লে দল বেঁধে এগিয়ে যায় সবাই। প্রতিশোধ নিতে ভুল করে না তারা। এরা মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। আর খাবার শেষে উচ্ছিষ্ট খাবারের অপেক্ষায় থাকে সে। খাবার শেষে প্লেট রাখতেই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় খাবারের কাছে। ময়লা বলে ফেলে দেওয়া জিনিসগুলো খেয়ে, শহর পরিষ্কার রাখে। তাই সে নাম পেয়েছে ঝাড়ুদার। তবে আগে অনেক কাক দেখা যেত এখন সেটি প্রায় বিলুপ্তর পথেই।
উপজেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত কবি মনোয়ার সুলতানের সাথে কথা বললে তিনি সঙ্গীর প্রতি কাকের ভালবাসা উল্লেখ করে বলেন, 'প্রেমের মত সুন্দর পৃথিবীতে আর কি আছে! একসাথে অনেকটা পথ হাটা.... কত কথা, কত গল্প আর কতশত নতুন স্বপ্নের মিতালি।' মানুষের মত প্রেমে বুদ হয়ে রয় কাকেরাও। তবে কাক ও মানুষের ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য একটাই মানুষ সঙ্গী ছেড়ে, নতুন মানুষের সাথে ঘর বাঁধে। কিন্তু কাক একবার তার সঙ্গী হারালে আর ঘর বাঁধে না। এমন কথায় শোনা যায় লোকমুখে।