প্রকৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঘুঘুর মিষ্টি ডাক

news paper

বারহাট্টা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৩-৫-২০২৫ দুপুর ১:৩

57Views

'এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে, এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে....' কবি জীবনানন্দ দাশের 'এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে' কবিতায় ক্লান্ত বিকেল শেষে সূর্য যখন অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়, তখন ঘুঘু পাখির ডাক মানুষের মনে ছড়িয়ে দেয় শান্তির পরশ। একসময়ে আবহমান গ্রাম বাংলার মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে, দিগন্ত জুড়া ফসলের মাঠে, বাড়ির আঙিনায়, গাছে গাছে ঘুঘু পাখি দেখা গেলেওকালের বিবর্তনে সারা দেশের মতো বারহাট্টার প্রকৃতি থেকেও ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে অতি পরিচিত ঘুঘু পাখি।

শুধুমাত্র গহিন বন-জঙ্গল নয়। একসময়ে ধান খেত, ঝোপ-ঝাড়, বাড়ির আঙিনাসহ সব জায়গায়তেই ছিল ঘুঘু পাখির অবাধ বিচরণ। সাধারণত সবুজে ঘেরা বন-জঙ্গলের নির্জন পথে ঘুঘু জাতীয় পাখিদের বিচরণ ভূমি। একসময়ে ভোরের আলো ফোটার সময়ে বন-জঙ্গলের নির্জন পথে এই পাখিদের দেখা মিলতো। ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুঘু পাখিরা দু-একটি দলে মিলিত হয়ে মাটি থেকে খুটে খুটে খাবার খেতে আসতো। সকালের স্নিগ্ধতায় এরা প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্য হয়ে ধরা দেয়। নিরাপদ আবাস, খাদ্যের অভাব, শিকারীদের নির্বিচারে পাখি নিধন, ফসলের জমিতে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে দিনের পর দিন আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অতি পরিচিত ঘুঘু পাখি।

সরেজমিনে উপজেলা সদরসহ কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রাম ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা জানান, একসময়ে ধানের জমিতে ঘুঘু পাখির উৎপাত কৃষককে আনন্দ দিতো। ঝোপ-জঙ্গল, খোলা মাঠ, গ্রাম বা আশপাশে বড় বড় গাছ আছে এমন কৃষি জমিতে এদের দেখা মিলতো। এমন এক সময় ছিল গ্রাম বাংলার কৃষকের মাঠের ধান ঘরে উঠছে এই আনন্দে ঘুঘুর ডাকে মুখরিত হয়ে উঠতো পরিবেশ। কিন্তু এখন আর আগের মতো অতি পরিচিত এ পাখিটি তেমন দেখা যায় না। দুই একটা গ্রামে দেখা গেলেও তার সংখ্যা খুবই কম। এখন পথে-প্রান্তরে সকাল-দুপুর কিংবা সন্ধ্যায় ক্রউ-ক্রউ-ক্রউ স্বরে ঘুঘু পাখির মিষ্টি মধুর ডাক আর শোনা যায় না।

উপজেলা সদরের গড়মা গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সহকারি চাকুরিজীবী সমীন্দ্র দও বলেন, কালের বিবর্তনে অন্যান্য সব পশুপাখির মতো ঘুঘু পাখিও আজ বিলুপ্তির পথে। একসময়ে উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের বনগুলোতে প্রায় সর্বত্রই লাল, সবুজ, নীল ও খয়েরি বর্ণের ঘুঘুর বিচরণ ছিল। এরা সাধারণত জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। এরা কৃষিজমি, খামার, ঘাসপূর্ণ মাঠ, ঝোপ এবং বাড়ির আঙিনায় হেঁটে হেঁটে খাবার সংগ্রহ করে। মূলত ধানই ঘুঘুর প্রধান খাদ্য। তাছাড়া ঘাস ও আগাছার বিচি, শস্যদানা, গাছের কুঁড়ি ও কচি পাতাও খায় এরা। অনেকে আবার শখের বশে খাঁচায় করে বাসায় পুষতো। বনে-জঙ্গলে, শহরে, গ্রামে সব জায়গায় এই পাখি প্রচুর দেখা গেলেও বর্তমানে পরিচিত এই পাখিটি খুবই কম দেখা যায়।

এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, শিকারি কর্তৃক ঘুঘু শিকার এর একটি অন্যতম কারণ। অনেকে শখের বশে বন্দুক দিয়ে এই পাখি শিকার করে থাকেন। যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। এছাড়াও ঘুঘু পাখি ঝোপ ঝাড়ে ও ছোট গাছে এবং মানুষের বসত বাড়ির আশেপাশে বাসা বানায়। এজন্য শিকারীরা সহজেই ঘুঘু শিকার করতে পারে। এছাড়াও কৃষি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত খাবার খেয়ে পাখির সংখ্যা ও ডিম দেয়ার পরিমাণ কমে যাওয়া, ঝোপ-ঝাড় ও গাছপালা কেটে ফেলায় নিরাপদ আবাস স্থলের অভাব, নির্বিচারে পাখি শিকার করাসহ বিভিন্ন কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির পাখি বলে পরিচিত ঘুঘু পাখি।

বারহাট্টা সরকারি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রভাষক মজিবুল হক বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির ঘুঘু (তিলা ঘুঘু, রাম ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ছোট ঘুঘু ও লাল ঘুঘু) পাওয়া গেলেও, তিলা ঘুঘু ছাড়া অন্য ৫ টি প্রজাতির ঘুঘু খুব একটা দেখা যায় না বললেই চলে। আমাদের দেশে সচরাচর যে ঘুঘু দেখা যায়, সেটি হলো তিলা ঘুঘু। এটি তেলিয়া ঘুঘু ও ছিটে ঘুঘু নামেও পরিচিত। তিলা ঘুঘুর বৈজ্ঞানিক নাম (Steptppelia Chinensis)। এরা Columbidae গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Streptopelia গণের অন্তর্গত অত্যন্ত সুলভ এক প্রজাতির ঘুঘু।  এরা খুব বেশি সুলভ পাখি হওয়ায় এদের অনেকগুলো নাম রয়েছে: তিলা ঘুঘু, তেলিয়া ঘুঘু, ছিটে ঘুঘু ইত্যাদি। এ পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ২৭ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ১২০ গ্রাম। মাথার চাঁদি ও কান-ঢাকনি ধূসর। ঘাড় কালো এবং তাতে থাকে অসংখ্য সাদা ছিট-ছোপ। বাদামি পিঠ ও ডানায় পীতাভ তিলা রয়েছে। চোখ ফিকে লালচে বাদামি, চোখের পাতা ও চোখের গোলকের মুক্ত পট্টি অনুজ্জ্বল গাঢ় লাল। এদের ঠোঁট কালচে রঙের, পা ও পায়ের পাতা লালে মেশানো এবং নখর বাদামি। স্ত্রী ও পুরুষ ঘুঘু দেখতে একই রকম। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে মিলেই পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে ১৩-১৪ দিন সময় লাগে। বাচ্চার বয়স দুই সপ্তাহ হলেই উড়তে শুরু করে।

বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কালেরকন্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, বিলুপ্ত প্রায় ঘুঘু পাখি সচরাচর কৃষি জমি, খামার, ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল ও গ্রামের গাছে গাছে দেখা মিলতো। অথচ প্রকৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে অতি পরিচিত ঘুঘু পাখি। প্রকৃতি বান্ধব এই ঘুঘু পাখি রক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে ঘুঘু পাখি একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার কয়েকটি গ্রামের ঘুঘু পাখি শিকারীরা বলেন, একসময়ে প্রতিদিন নিজের পালিত ঘুঘু দিয়ে ফাঁদ পেতে ৮-১০ জোড়া ঘুঘু পাখি শিকার করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতাম। বর্তমানে ঘুঘু পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন আর ফাঁদে তেমন ঘুঘু ধরা পড়ে না তাই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছি।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঘুঘু পাখি অত্যন্ত ভীতু ও লাজুক প্রকৃতির পাখি। সাধারণত বছরে এক জোড়া ডিম দেয়। সেই ডিমে তা দিয়ে নিজেই বাচ্চার জন্ম দেয়। বিস্তীর্ণ জমির গাছের ডালে, আড়ালে আবডালে এরা বাসা করে ডিম থেকে বাচ্চা দিত। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত খাবার খেয়ে পাখির সংখ্যা ও ডিম পাড়ার পরিমাণ কমে যাওয়া, ঝোপ-ঝাড় ও গাছপালা কেটে ফেলায় নিরাপদ আবাসস্থলের অভাব, নির্বিচারে শিকার করা সহ বিভিন্ন কারণে ঘুঘু পাখি বর্তমানে বিলুপ্ত হতে চলেছে।


আরও পড়ুন