গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে বেকারত্বের তথ্যচিত্র এবং পরিসংখ্যানগত তুলনামূলক বিশ্লেষণ!
প্রকাশিত: ১৫-৪-২০২৫ দুপুর ২:১৫
বাংলাদেশে বেকারত্ব একটি গুরুতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা। গত ২৫ বছরে বেকারত্বের হার ও সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। নিচে এই সময়কালের বেকারত্বের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হলো:
বেকারত্বের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ (২০০২-২০২৫):
· ২০০২-২০০৩: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট বেসামরিক শ্রমশক্তি ছিল ৫ কোটি ৬৩ লাখ। এর মধ্যে বেকারের সংখ্যা ছিল ২০ লাখ, যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩.৫৫%।
· ২০০৫-২০০৬: একই জরিপে দেখা যায়, শ্রমশক্তি বৃদ্ধি পেয়ে ৪ কোটি ৯৫ লাখে পৌঁছায়, যেখানে বেকারের সংখ্যা ছিল ২১ লাখ, যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪.২৪%।
· ২০১০-২০১৫: এই সময়ের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সীমিত হলেও, বেকারত্বের হার প্রায় ৪-৫% এর মধ্যে ছিল বলে ধারণা করা হয়।
· ২০১৬-২০১৭: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বেকারত্বের হার ছিল ৪.২%, যা সংখ্যায় প্রায় ২৭ লাখ বেকারকে নির্দেশ করে।
· ২০২৩: বিবিএসের তথ্যমতে, বেকারত্বের হার কমে ৩.৬% এ নেমে আসে, যা সংখ্যায় প্রায় ২৬ লাখ ৩০ হাজার বেকার।
· ২০২৪: বেকারের সংখ্যা বেড়ে ২৫ লাখ ৯০ হাজারে পৌঁছায়, যেখানে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নারী বেকারের সংখ্যা কিছুটা কমেছে।
· ২০২৫: সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৫০ হাজারে দাঁড়িয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১ লাখ ২০ হাজার বেশি।
বাংলাদেশে বেকারত্বের হার গত ২৫ বছরে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও, তরুণ ও উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাব্যবস্থা ও শ্রমবাজারের মধ্যে সমন্বয়, দক্ষতা উন্নয়ন, এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।
বেকারত্ব হ্রাসে বাংলাদেশ ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে কিছু মিল এবং পার্থক্য রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর নীতি সাধারণত বেশি কাঠামোগত এবং প্রযুক্তিনির্ভর, যেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে চ্যালেঞ্জের ধরন ভিন্ন। নিচে এই দুই অঞ্চলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
মিলসমূহ:
1. দক্ষতা উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব
· বাংলাদেশ ও উন্নত দেশ উভয়ই দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
· উন্নত দেশগুলোতে যেমন STEM (Science, Technology, Engineering, and Math) শিক্ষা জনপ্রিয়, তেমনি বাংলাদেশেও কারিগরি শিক্ষা ও ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ সম্প্রসারিত হচ্ছে।
2. উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপ সহায়তা
· উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তাদের জন্য নীতিগত সহায়তা ও ফান্ডিং সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
· বাংলাদেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম যেমন Startup Bangladesh গঠিত হয়েছে, যেখানে সরকার ও বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করছে।
3. প্রযুক্তি ও আইটি খাতের ব্যবহার
· বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগোচ্ছে এবং আইসিটি সেক্টরে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।
· উন্নত দেশগুলোতেও অটোমেশন ও ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ফলে নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
4. বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ
· উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরি করে এবং বহুজাতিক কোম্পানিকে আকৃষ্ট করে।
· বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (Economic Zones) স্থাপনের মাধ্যমে এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।
পার্থক্যসমূহ:
বিষয় |
উন্নত দেশসমূহ |
বাংলাদেশ |
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন |
কর্মমুখী ও গবেষণাধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত, যেখানে চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের তৈরি করা হয়। |
সাধারণত তাত্ত্বিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়, দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা তুলনামূলক কম।
|
টেকসই কর্মসংস্থান |
টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদী চাকরির ব্যবস্থা বেশি, যেখানে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা থাকে। |
অস্থায়ী ও অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান বেশি, যা কম নিরাপদ ও অনিশ্চিত।
|
সরকারি উদ্যোগ ও নীতি |
সরকার অটোমেশন, AI, এবং গ্রীন টেকনোলজিতে দক্ষতা উন্নয়ন করে নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। |
কৃষি ও পোশাক শিল্পের মতো প্রচলিত খাতগুলোর উপর নির্ভরশীলতা বেশি।
|
বেকার ভাতা ও সহায়তা |
কর্মহীনদের জন্য বেকার ভাতা, পুনঃপ্রশিক্ষণ এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া হয়। |
বেকারদের জন্য সরকারি সহায়তা সীমিত এবং খুব কমসংখ্যক মানুষ বেকার ভাতা পায়।
|
নারী কর্মসংস্থান |
নারীরা চাকরির বাজারে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে, ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক অপশন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা এবং কাজের পরিবেশ উন্নত। |
নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে।
|
প্রযুক্তি ও অটোমেশন |
প্রযুক্তির কারণে পুরনো চাকরি কমলেও নতুন ধরনের চাকরির সুযোগ তৈরি হয় (যেমন: ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি)। |
প্রযুক্তি অটোমেশন ধীরে এগোচ্ছে, ফলে কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হলেও পর্যাপ্ত নয়।
|
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার |
উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় এবং বৈধ অভিবাসন নীতি গৃহীত হয়। |
বাংলাদেশি শ্রমিকরা মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি করে, কিন্তু শ্রমিকদের অধিকাংশই কম দক্ষ।
|
উন্নত দেশগুলো সাধারণত কর্মসংস্থানের গুণগত মান নিশ্চিত করে এবং বেকারদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে মূলত কৃষি, পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্স নির্ভর নীতিগুলো নেওয়া হয়।
বাংলাদেশে বেকারত্ব কমাতে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি বহুমুখী সমস্যা, যার সমাধানে সরকারকে নীতি-নির্ধারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। নিচে কিছু মূল দিক উল্লেখ করা হলো:
১. দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
• প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা (TVET) সম্প্রসারণ করা।
• সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন করা।
• বেকার যুবকদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং ও আইটি প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
২. শিল্প ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ
• দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করা।
• নতুন শিল্প ও অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করে কর্মসংস্থান তৈরি করা।
• ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (SME) সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা।
৩. স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তা সহায়তা
• তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য অনুদান ও বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করা।
• সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ইনকিউবেশন সেন্টার গঠন করা।
• কর ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে উদ্যোক্তা বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।
৪. কৃষি ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
• কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধি করা।
• কৃষিভিত্তিক শিল্প ও অ্যাগ্রো-প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করা।
• গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করতে স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র উদ্যোগকে সহায়তা করা।
৫. তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল অর্থনীতি বিকাশ
• ই-কমার্স, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা।
• সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর ছাড় ও সুবিধা দেওয়া।
৬. সরকারি চাকরি ও সুশাসন নিশ্চিত করা
• চাকরির বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
• সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ বাড়ানো ও নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা।
৭. প্রবাসী কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স নীতি উন্নয়ন
• দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলে আন্তর্জাতিক বাজারে কর্মসংস্থান বাড়ানো।
• বিদেশগামী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা প্রদান করা।
• রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান করা।
সরকার যদি এসব উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।