যান্ত্রিক সভ্যতার ভীড়ে বিলুপ্ত প্রায় পালতোলা নৌকা
প্রকাশিত: ৪-৩-২০২৫ দুপুর ২:৩৫
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আবহমান গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ঐতিহ্যবাহী পালতোলা নৌকা।আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও যান্ত্রিক সভ্যতার ভীড়ে পালতোলা নৌকা এখন শুধুই স্মৃতি!
নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় নৌকাই ছিল আদি বাহন। নদীতে সারি সারি পালতোলা নৌকার সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। মাঝির আবেগময় কণ্ঠে আর শোনা যায় না- ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে...আমি আর বাইতে পারলাম না’, ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে.. পুবালী বাতাসে- বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি আমার নি কেউ আসে রে’ এমন সেই হৃদয়ে দোলা লাগানো ভাটিয়ালি গান। এছাও পালের নৌকাকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন কত শত গল্প, কবিতা, ছড়া, পালাগান। চিত্রকর এঁকেছেন নান্দনিক শিল্পকর্ম। কালের বিবর্তণ, জৌলুস হারানো নদ-নদীর করুণ অবস্থা ও যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশে বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় আবহমান গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ঐতিহ্যবাহী পালতোলা নৌকা।
উপজেলার কংশ, বিষনাইল, ধনাইখালী কাউনাই, ধনাইসহ ছোট-বড় অনেক নদ-নদী বেষ্টিত এলাকার বেশির ভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল বর্ষায় ভরা নদ-নদীর ঢেউ আর পালের নৌকা, ডিঙ্গি নৌকাসহ হরেক রকমের নৌকার সম্পর্ক। নব্বইয়ের দশকেও নদ-নদীগুলোর নৈসর্গ রূপের সৌন্দর্য ছিল সারি সারি নৌকা। এসব নৌকায় ছিল রঙিন পাল, স্বচ্ছ পানির কলতান আর পালে লাগা বাতাসের শব্দ অনুভূতি জুগিয়েছে প্রাণে। সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল উড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মনপ্রাণ আনন্দে নেচে উঠতো সবার। নদ-নদী গুলোতে এখন যেটুকু সময় পানি থাকে বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কিছু কিছু এলাকায় নৌকা চলাচল করলেও এখন পালতোলা নৌকার দেখা মিলে না। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেল চালিত ইঞ্জিন।
উপজেলার দশধার এলাকার ৭৫ বছর বয়সী কালাচাঁন মাঝির সাথে কথা বললে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আহারে! আগে খালে-বিলে-নদীতে কত রকম নৌকা চলত। নাইয়রি নৌকা, পালতোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, সাপুড়িয়া নৌকা, ভোট নৌকা, পানসি নৌকা, বৌচোরা নৌকা, গয়না, লক্ষ্মী বিলাস, গণ্ডী বিলাস, বজরা, খেয়া নৌকা, কোসা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা, বাইচের নৌকা ও মহাজনী নৌকা। সেইসব দিনগুলা অহন (এখন) শুধুই স্মৃতি। গ্রামীণ নৌকা জীবনে আইছে (এসেছে) যান্ত্রিকতা। অহন আর মাঝিকে গুণ টাইনা নৌকা চালাইতে হয় না, পরিশ্রম ছাড়াই স্যালু মেশিন দিয়াই চলে।
বারহাট্টা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মানিক আজাদ বলেন, শৈশব থেকেই নদী আর নৌকা আমাদের বাঙালীর প্রতিটি মানুষের অস্তিত্বে মিশে ছিল। এক সময় সেইসব নৌকাই ছিল মানুষজনের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিনন্দন পালতোলা নৌকায় নদীভ্রমণে তৃপ্ত হতো আমাদের মন। সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল ওড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মানুষের মনপ্রাণ ভরে যেত। কিন্তু সেই চিরচেনা দৃশ্যটি এখন বিলুপ্তির পথে।
তিনি আরও বলেন, নদী হারিয়েছে নাব্যতা, নদীর উপরে হয়েছে ব্রিজ। বিলগুলো পানিশূন্য থাকে সারা বছর। জলাশয়গুলো বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। পালতোলা নৌকা চলবে কোথায়? তাই এখন শুধুই স্মৃতির জাবরকাটা।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক শামছ উদ্দিন আহমেদ বাবুলের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আগে নদীর পাড়ে দল বেঁধে মানুষ পালতোলা নৌকার সে দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যেতো। আর মাঝ নদী থেকে ভেসে আসা দরাজকণ্ঠে ভাটিয়ালি গানের সুর শুনে মনে তৃপ্তি এনে দিতো। নদীকে ঘিরে এক সময় পালতোলা নৌকা ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। এপাড় থেকে ওপাড়ের যাত্রীদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত নৌকা। কালের পরিক্রমায় এসব নৌকা এখন অতীত।