রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ:

অধ্যক্ষ কালাচাঁদের পাহাড়সম অনিয়ম-দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী

news paper

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৭-১-২০২৫ রাত ৯:৯

636Views

রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন প্রফেসর কালাচাঁদ শীল। তার যোগদানের পর থেকেই শুরু হয় নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণ ওদমন-পীড়নমূলক কর্মকান্ড। তার এমন ব্যবহারে ভীষণ অতিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। অধ্যক্ষ কালাচাঁদের সঙ্গে ওপর মহলের পরিচিতি ও ঘনিষ্টতা থাকায় ভয়ে মুখ খুলতে চান না কেউ-ই। তবে সম্প্রতি অধ্যক্ষের হাসিনা বন্দনামূলক একটি ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে, অধ্যক্ষের বেশকিছু অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণ ও স্বেচ্ছাচারিতার তথ্য প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। 

নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছে থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে জানা গেছে, যোগদানের পর থেকেই অধ্যক্ষ কালাচাঁদ কলেজে কর্মরত ৫৮ জন মাস্টাররোলে কর্মরত কর্মচারীর বেতন নিয়ে করেছেন বৈষম্য। কেউ কেউ ২৫ থেকে ৩৫ বছর ধরে চাকরি করলেও তাদের বেতন কম রেখে তার (অধ্যক্ষের) সময়ে নিয়োগকৃতদের বেতন নির্ধারণ করেছেন নিজের খেয়ালখুশি মতো। এর প্রতিবাদ করায় অনেক কর্মচারীর বেতন বন্ধ করেছেন তিনি। কেউবা হারিয়েছেন চাকরি। আবার অনেক কর্মচারী ছুটি নেওয়া সত্ত্বেও বেতন কর্তন করেছেন। 

২০০৩ সালে ২ ফেব্রুয়ারি মাস্টাররোল কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন মো. সুমন আলী। কালাচাঁদের হাতে তিনিও হয়েছে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার। প্রতিবেদককে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ যোগদানের পর বেশকিছু  কর্মচারীকে কারণ ব্যতীত ছাটাই করেছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের সুপারিশ ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে ১৪ জনকে নিয়োগ দেন। এর মধ্যে মিতুল দাস নামের এক নারীকে গানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। অভিযোগ আছে, বছরের পর বছর ধরে মসজিদের ইমামের বেতন না বাড়িয়ে তিনি অপ্রয়োজনে নিয়োগ দেওয়া গায়িকার বেতন বৃদ্ধি করেছেন। অথচ, এমনকি তার আপ্যায়নের জন্যও থাকত আলাদা বাজেট। এসব নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে অধ্যক্ষের তোপের মুখে পড়তে হতো।

কলেজ সংশ্লিষ্ট আরও একাধিক কর্মচারীর অভিযোগ, ডিগ্রি কলেজের সাবেক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বায়তুল হোসেন তরুর আপন দুই বোন যথাক্রমে বুলবুলি ও জেসমিনকে সহ সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি মইনুল ইসলাম বাপ্পির বোন লাবনীকেও মাস্টাররোলে নিয়োগ দেন অধ্যক্ষ কালাচাঁদ। কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীকে শাসন-বারণ করতে হলে সাবেক এ দুই ছাত্রলীগ নেতাকে ব্যবহার করতেন তিনি। উল্লেখ্য, তরু ও বাপ্পি ৫ আগস্টের সময় অস্ত্রহাতে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার ছবি প্রকাশের পর তারা পলাতক। তারা দু’জনেই রাজশাহী সিটি করপোরেশনে অস্থায়ীভাবে চাকরি করতেন বলে জানা গেছে। অধ্যক্ষ কালাচাঁদের বিরুদ্ধে রয়েছে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতি ও ঠিকাদারকে সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ। ২০২৪ জুলাই মাসের শেষভাগে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বন্দনামূলক আড়ম্বরপূর্ণ একটি ম্যাগাজিন বের করেন। যেখানে বিধি অনুসারে ৫ লাখ টাকা খরচের অনুমতি থাকলেও তিনি তা অতিক্রম করে প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। অথচ, এসবের একটিরও ব্যবহার হয়নি, যার সবই গুদামজাত হয়ে পড়ে আছে। এছাড়াও হাসিনা বন্দনার অযুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে তছরূপ করেছেন লাখ লাখ টাকার সরকারি অর্থ। 

জানা গেছে, মাউশির প্রকল্প পরিচালকের নির্ধারিত স্থানে প্রকল্পের বিল্ডিং না নির্মাণ করে ঠিকাদারকে বাড়তি সুবিধা প্রদানের জন্য তিনি নিউ ডিগ্রি কলেজের খেলার মাঠের পূর্ব দিকের একটি বড় অংশ নষ্ট করে সেখানে নির্মাণ করেছেন ১৪০ ফিটের ৬ তলা ‘বিজ্ঞান ভবন’। যা শিক্ষা বিধি ও পরিবেশ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ কাজটিও করেছেন আ.লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে তোষণে জন্য এবং নিজে আর্থিকভাবে লাভবানের জন্য। 

দাপ্তরিক সূত্রে জানা গেছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির কাজে অধ্যক্ষ কালাচাঁদের খাস ব্যক্তি হিসেবে ক্যাম্পাসে গুঞ্জন রয়েছে শফিকুল ইসলাম সুইট, মোহাম্মদ মহশীন ও মো. হারুনর রশিদ। তিন পান্ডবের সহায়তায় অধ্যক্ষ তার নানান অপকর্ম ও দুর্নীতি এখন পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। একাধিক শিক্ষক, কর্মচারীর অভিযোগ, প্রায় এক বছর যাবৎ হিসাব রক্ষক মো. সাজ্জাদ হোসেন নিউ ডিগ্রি কলেজে পদায়ন পেলেও তাকে শুধুমাত্র ফাঁকা কাগজে স্বাক্ষর ছাড়া কোনো প্রকার দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দেননি। এসব কাজ করেন অধ্যক্ষের পচ্ছন্দের মাস্টাররোলে কর্মরত কিছু কর্মচারী। 

এবিষয়ে হিসাব রক্ষক সাজ্জাদ বলেন, আমি সরকারি কর্মচারি। কলেজে যোগদানের পর থেকে এক বছর শুধু হাত-পা নিয়েই বসে আছি। কোনো প্রকার কাগজ-কলম দেওয়া হয়নি। আমার কাজ শুধু সই করা। আর্থিক লেনদেনের সমস্ত হিসাব পরিচালনা করেন অস্থায়ীভিত্তিক কর্মচারী হারুন ও মহসিন। এ বিষয়ে মাউশিতে একবার অভিযোগও করেছিলাম। এতে উল্টো বিপদে পড়তে হয়। তাই এখন চুপচাপ থাকি, আর কোনো কথাই বলি না; বলার সুযোগও নেই।

অধ্যক্ষের হাসিনা বন্দনার জ্বলন্ত প্রমাণ মিলেছে সাম্প্রতিক সময়ে। নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের পরীক্ষার খাতা, প্যাড, ফোল্ডার, বিভিন্ন আকারের খাম, কলেজ ম্যাগাজিন সহ বহু অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্রে হাসিনা বন্দনা করেছেন তিনি। প্রতিবেদকের হাতে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রসায়ন বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ইনকোর্স পরীক্ষার ৭২০টি খাতা এবং একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের টেস্ট পরীক্ষার ৬৩০টি খাতায় (২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলাকালীন পরীক্ষা) ‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ সম্বলিত লোগোর ব্যবহার করেছেন তিনি। পরে এনিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি ‘ভুল হয়েছে বলে’ গণমাধ্যমকে জানান। তবে, কলেজে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা জানান তিনি জেনে-শুনে এসব চাপ দিয়েই করিয়েছেন। 

শুধু দুর্নীতি এবং অনিয়মই নয়, অধ্যক্ষ কালাচাঁদের বিরুদ্ধে রয়েছে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও। রাজশাহীর তৎকালীন এডিশনাল এসপি বিজয় বসাকের ভয় দেখিয়ে অনেককেই হয়রানি করতেন তিনি। বিদেশী একটি এ্যাম্বাসির সাথেও তার রয়েছে গভীর সখ্যতা। এই সখ্যতার প্রভাব খাটাতেন নিজ কর্মস্থলেও। তাছাড়া তার বন্ধু মহলের অনেকেই বড় বড় জায়গায় অবস্থান করার সুবাদে তাদের সহযোগিতা নিয়েও কলেজে তিনি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। 

বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কথা হয় রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ কালাচাঁদ শীলের সাথে। প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আমার বিষয়ে আনীত অভিযোগ গুলো সত্য নয়। তবে হাসিনা বন্দনার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন 'কিছু কাজ ভুলবশত হয়ে গেছে'।


আরও পড়ুন