হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার খেজুরের রস, নতুন গুড়ের ঘ্রাণে গাছিরা ভুলে যান ঘাম ঝরানো কষ্ট

news paper

শামীমুল ইসলাম শামীম, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: ২৬-১২-২০২৪ দুপুর ৪:১৭

75Views

এক দশক আগেও শীতের সকালে গাছির ব্যস্ততার দৃশ্য চোখে পড়ত। ঘুম থেকে উঠে কাঁধে বাঁশের তৈরি বাঁক নিয়ে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করত। শীতের মৌসুমের শুরু থেকে বাড়ি বাড়ি খেজুরের রস কিংবা রসের পাটালি গুড় দিয়ে তৈরি মজাদার পিঠাপুলির আয়োজন হতো। গ্রাম বাংলার এ দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মধুবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত খেজুর গাছ। গাছিরাও এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।

খেজুরের রস এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না। শীত-মৌসুমের প্রধান মজা রসে ভেজা পিঠাসহ অন্যান্য ঐতিহ্যগত আয়োজনও কমে যাচ্ছে। প্রকৃতিগত সুস্বাদু সে রস এখন আর নেই। শীত-মৌসুমে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষকে ঘিরে গ্রামীণ জনপদ থাকত উৎসবমুখর। এ সময় মেহমান আসা মানেই খেজুরের রস ও নতুন চালের ভাঁপা পিঠাপুলি ও পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন। তাছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া ও মুড়ি খাওয়ার জন্য কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের শীতের মৌসুম ছিল প্রিয়। কিন্তু আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের বাহক গ্রামগঞ্জ থেকে খেজুরগাছ আজ বিলুপ্তির পথে।

ভোরে মুক্তাদানার মতো শিশির ভেজা ঘাস। নতুন ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ আর হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা, পাখি ডাকা, ছায়াঘেরা মায়াভরা দিগন্ত প্রসারী সবুজ-শ্যামলে নকশা আঁকা মাঠঘাট ভরা ফসলে। এমনই শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে সুস্বাদু খেজুরের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। মৌসুমি খেজুরের রস দিয়ে শীতের আমেজ শুরু হতো আবহমান বাংলার গ্রামীণ জনপদে। শীতকালে নতুন ধানের চাল দিয়ে বিভিন্ন রকমের পিঠাণ্ডপায়েস তৈরিতে খেজুরের রস ও গুড়ের জুড়ি নেই। কিন্তু সেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুরের রস এখন আর তেমন দেখা যায় না।

সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক নগরায়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা খেজুর গাছ ও রস। একসময় গ্রামীণ অধিকাংশ রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে ও কৃষিজমির পাশে ছিল প্রচুর খেজুর গাছ। শীত-মৌসুম শুরু হতেই খেজুরের রস সংগ্রহের কাজে গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ত। সেই রসের চাহিদাও ছিল প্রচুর। বিভিন্ন পিঠাপুলি ও পায়েসসহ নানান খাবার তৈরির জন্য খেজুরের রস ছিল অন্যতম উপাদান। এজন্য গাছিদের চাহিদার কথা আগেই বলে রাখতে হতো। ফলে যাদের খেজুর গাছ ছিল না, তারাও রস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হতো না।

শীত মৌসুম এলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ বলে খ্যাত খেজুরগাছের রস দিয়ে উৎসব শুরু হতো। খেজুরের রস ও খেজুরের মিঠার গন্ধে গ্রামীণ জনপদ মৌ মৌ করত। শীত আসতেই খেজুর গাছ রসের উপযোগী করতে গাছিরা ব্যস্ত হতো। গাছিরা এ সময় অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতো। কালের বিবর্তনে অর্থনীতির চাকাকে চাঙ্গা করতে গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনেক গাছের মতো খেজুর গাছও কেটে ফেলে লাগানো হচ্ছে কাঠের গাছ। শীতে গ্রামজুড়ে আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করত। পৌষ-মাঘের শীত-মৌসুমে গাছিদের আনন্দের সীমা থাকত না। খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য মহাব্যস্ত হয়ে পড়ত তারা। সকাল হলেই রস সংগ্রহ করত আর বাজারে নিয়ে বিক্রি করত।

ভরা মৌসুমে খেজুর গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ আর গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ঝিনাইদহ জেলার গাছিরা। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস। আর রস থেকে তৈরী হয় গুড়, পাটালি, পায়েসসহ নানা ধরনের পিঠা পুলি। গাছ কেটে একফোটা রস বের করতে যে ঘাম ঝরে একজন গাছির তার মূল্য সহজে ঘরে আসে না। কিন্তু গাছি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা জ্বালিয়ে গুড় তৈরী করে তার ঘ্রাণে গাছিরা ভুলে যায় সেই ঘাম ঝরানো কষ্টের কথা। নতুন প্রজন্মের গাছিরা কষ্টের কারণে খেজুর গাছ কাঁটতে চইনা বলেই হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুরের রস আর গুড়। তবে এলাকায় ব্যপক চাহিদা থাকায় বয়স্ক গাছিরা এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন। প্রতি বছর শীত মৌসুমেই দেখা মেলে এই খেজুর রসের পায়েস আর বিভিন্ন ধরনের পিঠ-পুলির। বর্তমানে বাজারে খেজুরের গুড় বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০টাকায়। গুড়ের বর্তমান দামেও খুশি গাছিরা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঝিনাইদহে রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ খেজুরগাছ। জমির আইলে ও পতিত জায়গায়ও রয়েছে অসংখ্য খেজুর গাছ। বিশেষ করে জেলার ৬ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা মেলে এ দৃশ্য। গাছিরা প্রথমে গাছের মাথা থেকে ডালপালা কেটে পরিষ্কার করেন। পরে নির্দিষ্ট স্থান হালকা করে কেটে পরিষ্কার করেন। এর কিছুদিন বিরতির পর গাছের পরিস্কার করা অংশ শুকিয়ে নিয়ে আবার কয়েক দফায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে ছেঁটে ফেলা হয় গাছের ছাল। গাছ কাটার এ কাজে গাছিরা ধারাল অস্ত্র  ব্যবহার করেন। গাছ কাটার সময় খেজুর গাছের সঙ্গে নিজেদের শক্তভাবে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেন তারা। তাদের কোমরে থাকে বাশেঁর তৈরী ঠোঁঙ্গা (স্থানীয় ভাষায়) যার ভেতর থাকে গাছ পরিষ্কার করার দাসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। গাছ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর থেকেই মূলত রস নামানোর পর্বটা শুরু হয়।

এরপর গাছের মাথার নির্দিষ্ট স্থানে পাত্রের (ভাড়) ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরী একটি নলি ও দুপাশে দু’টি চোখা বা খুঁটি পোতা হয় যার সাথে রস সংগ্রহের পাত্র (ভাড়) ঝুলিয়ে রাখা হয়। এভাবেই গাছির নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে খেজুরের রস।ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উদয়পুর গ্রামে, খেজুরের রস আহরণ শুরু করেছেন ৬৫ বছর বয়সের গাছি শহিদুল ইসলাম। তিনি নিয়মিতভাবে গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, সপ্তাহের নির্ধারিত দিন বিকেলে গাছের মাথা হালকা ভাবে ছেঁটে নির্ধারিত স্থানে মাটির পাত্র (ভাড়) ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

পরদিন ভোরে গাছ থেকে পাত্র নামিয়ে আনা হয়। গাছভেদে দু’থেকে চার কেজি হারে রস পাওয়া যায়, যা থেকে এক থেকে দেড় কেজি গুড় হয়। সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন পরপর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। রস জ্বালিয়ে গুড় বানাতেও গাছিদের ভোগান্তি কম নয়। কারণ খেজুর গাছের ডাল ও অন্যান্য খড়ি সংগ্রহ করে এ রস থেকে গুড় বানাতে হয়। অসৎ ব্যবসায়ীরা অনেক সময় রসের মধ্যে চিনি মিশিয়ে গুড় তৈরী করে। ভাল গাছিরা এগুলো করেনা, দাম কম হলেও গাছিরা সন্তষ্টচিত্তে প্রতিদিন তাদের গাছ পরিচর্যা ও  রস সংগ্রহ করে থাকেন।


আরও পড়ুন