বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত গলাচিপার শহীদ সাগর গাজী এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ

news paper

সাঈদ ইব্রাহিম,পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১৬-১০-২০২৪ দুপুর ৪:৫৯

248Views

সাগর গাজী এইচএসসি পরীক্ষায় ৩.৯২ পয়েন্ট পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি পটুয়াখালীর গলাচিপার উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিলেন। সাগরের পাসের খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা শাহিদা বেগম ও বাবা সিরাজুল ইসলাম গাজী। ছেলের কথা বলে দুজনই অঝোরে কাঁদতে থাকেন।  

‘আইজ আমার সাগর বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হইতো, আমিও খুশি হইতাম। আইজ পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে খুশিতে বন্ধু-বান্ধবদের লইয়া ঘুরতে যেত, আমাকেও আনন্দ দিত।’ কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ সাগর গাজীর মা মোসা. শাহিদা বেগম। 

বাবা সিরাজুল ইসলাম গাজী বলেন, ‘ছেলেটা পরীক্ষায় পাস করেছে ঠিকই। কিন্তু মনে আনন্দ নেই। বরং পরীক্ষায় পাসের খবরে বুকের কষ্ট আরে বেড়েছে। আজ ছেলেটা বেঁচে থাকলে সেও খুশি হতো, আমরাও সবাই খুশি হতাম। সাগর আমাকে বলতো, বাবা আমার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে। তুমি আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবে? বললাম এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে পারলে তোকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াব। আমার ছেলেটাকে ওরা গুলি করে হত্যা করল। ছেলেটার কী অপরাধ ছিলো? কেন তাকে হত্যা করল? যারা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।’

মেজো ভাই শাওন গাজী বলেন, ‘সাগরের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। সাগরের পাসের খবর শুনে কষ্টে আমাদের বুকটা ভারি হয়ে গেছে। রেজাল্ট নিয়ে সাগরের বন্ধুরা বাড়িতে এসে তারাও কান্নাকাটি করেছে। সাগর বেঁচে থাকলে সবাই মিলে আনন্দ করত, ঘোরাঘুরি করত।’ 

সহপাঠী মো. সাব্বির হোসেন বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছি। সাগর পাস করেছে ঠিকই, কিন্তু সাগর আজ নেই। সাগরের কথা মনে করলেই কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। সাগরসহ আমাদের বন্ধুরা সবাই পাস করেছে এবং সবাই বেঁচে আছে। শুধু বন্ধু সাগর বেঁচে নেই। এ কষ্ট আর সইতে পারছি না।’

আরেক সহপাঠী অন্তর বলেন, সাগর নেই ভাবতেই পারি না। একসাথে কত আড্ডা দিয়েছি, গল্প করেছি। ওর কথা মনে পড়লেই দুচোখ জলে ভরে ওঠে। নিজেকে আর সামলাতে পারি না। ও যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে ওর রেজাল্টে ও কত খুশি হতো। আল্লাহ যেন ওকে মাফ করে দেন এবং কবুল করে নেন।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ডাকুয়া ইউনিয়নের পূর্ব পাড় ডাকুয়ার সিরাজুল ইসলাম গাজী ও শাহিদা বেগম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সাগর গাজী কনিষ্ঠ। গলাচিপার উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেছিলেন এবং একই কলেজ থেকে ২০২৪ সালের এইচএসসিতেও উত্তীর্ণ হন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে সাগর নিহত হন। সাগরের বাবা সিরাজ গাজী রাজমিস্ত্রির কাজ করেন এবং তা দিয়ে সংসার চালান। বড় ছেলে সুজন গাজী একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। মেজো ছেলে শাওন গাজী ঢাকার টঙ্গী সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে লেখাপড়া করছেন।

উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সাগর মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিল। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। সাগর ৩ পয়েন্ট ৯২ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ছাত্র হিসেবে ভালো ছিল এবং তার আচার-আচারণও ছিল সুন্দর। পরীক্ষা শেষে সে ঢাকায় গিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয় এবং ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আজ রেজাল্ট দেখে সাগরের জন্য মনটা খারাপ লাগছে।’ 

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে এইচএসসির একটি পরীক্ষা স্থগিত হয়। তাই সাগর ঢাকার উত্তরায় চাচার বাসায় বেড়াতে যায় এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের পর শুরু হয় ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাস। ঢাকার উত্তরায় বিজয় মিছিলে যোগ দেন সাগরও। এ সময় সাদা পোশাকধারীরা ফ্লাইওভারে উঠে মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। একটি গুলি সাগরের মাথার পেছনে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে সাগর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। ওই দিন রাতেই সাগরের মৃতদেহ তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপার পূর্ব পাড় ডাকুয়া এলাকায় নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশের বিজয়ের আনন্দ করতে না পারলেও বিজয়ের পতাকা উড়ছে শহীদ সাগর গাজীর কবরের পাশে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগের দিন ৪ আগস্ট সাগর গাজী নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন- ‘আজ যদি আমি মারা যাই বিজয়ের পর আমার কবরের পাশে পতাকা দিও। হয়তো লাশ হবো, নয়তো ইতিহাস হবো।’ শেষ পর্যন্ত সাগর লাশ হয়ে ফিরে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাই তার ইচ্ছে অনুযায়ী কবরের পাশে পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।


আরও পড়ুন