সখী ভালোবাসা কারে কয়

news paper

অধ্যাপক ফেরদৌসী পারভিন

প্রকাশিত: ৬-৬-২০২৩ বিকাল ৬:১৬

44Views

পৃথিবীতে সবচেয়ে পুরাতন, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দের নাম ভালোবাসা। প্রতারণায়  সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া শব্দটির নামও ভালোবাসা। এই ভালোবাসা নিয়ে কবিতা, গান, গল্প সব সমাজে লেখা হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। শব্দ জন্মের আগে তা প্রকাশিত হয়েছে আকার ইঙ্গিতে। যেভাবেই প্রকাশ পাক না কেন শব্দটি নিয়ে নানান বিতর্ক বিদ্যমান। আবার ভালোবাসা শব্দটি নিয়ে মনিষীদের দার্শনিক তত্ত্ব আছে। আমি তত্ত্ব কথার ঝুড়ি নিয়ে আসিনি। খুব সহজভাবে হৃদয়ে নাড়া দেয়া এই শব্দটি নিয়ে কথা বলবো আজ।

ইংরেজি LOVE শব্দটির পূর্ণাঙ্গ অর্থ হচ্ছে  দু’রকমের: Language of Valuable Emotion / Lose of Valuable Energy .  যে দুটি পূর্ণাঙ্গ রূপ আমরা দেখছি তাতে খুব সহজেই বলে দেয়া যায় লাভ বা ভালোবাসা একদিকে একে অপরের প্রতি খুব মূল্যবান আবেগ প্রকাশের ভাষা। অন্যদিকে ভালোবাসা বা লাভ ঠিকঠাক না হলে মূল্যবান মানসিক শক্তির অপচয় হয়ে থাকে। ভালোবাসা মানে যদি এসবই হয়ে থাকে তাহলে এই আবেগিক বিষয় নিয়ে এত বিড়ম্বনা কেন? ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা। কাছের মানুষদের প্রতি স্নেহের শক্তিশালী প্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। ভালোবাসার রকমভেদ আছে। ভালোবাসাকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই প্রকাশ করা যায়। ইতিবাচক ভালোবাসা মানুষের উদারতা, সহানুভূতি ও স্নেহের প্রতিনিধিত্ব করে। এক্ষেত্রে অন্যের ভালোর জন্য নিঃস্বার্থ থাকে ইতিবাচক ভালোবাসা এবং প্রিয় মানুষদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশিত হয়। ভালোবাসা একধরনের সংযুক্তি অপরের সবকিছুর সঙ্গে। সহজ করে বলতে গেল বলতে হয় ভালোবাসা, ঘনিষ্ঠতা, আবেগ ও প্রতিশ্রুতি। এই তিনটি উপলব্ধির সমন্বয়।

ভালোবাসা এবং প্রেম এই দুটি শব্দের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য না থাকলেও আমার কাছে একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে বলে মনে করি। আমরা এখনো বেশিরভাগ মানুষ মনে করি যে, প্রেম বা ভালোবাসা শুধু একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে হয়। এই ধারণাটাই ঠিক নয়। জাগতিক সবকিছুর প্রতিই ভালোবাসা বা প্রেম থাকতে পারে। শুধু পাত্রভেদে তার রূপ পরিবর্তন করে। বাবা-মা, সন্তান, ভাই-বোন, জীব, প্রকৃতি, সৃষ্টিকর্তা, দেশ এবং নারী-পুরুষ সবকিছুর প্রতি ভালোবাসা থাকে। কিন্তু  আকার পরিবর্তন করে তা বিভিন্ন রূপ নিয়ে ধাবিত হয়। ভালোবাসা বা প্রেম একই মুদ্রার দুটো পিঠ। এক এক পিঠ একেকভাবে আচরণ করে। ভালোবাসায় মোহ, মায়া, হারানোর ভয়, আনন্দ, চোখের জল সব থাকে। আর তাইতো পোষা বিড়ালটি হারিয়ে গেলে কষ্টে বুক ভেঙে যায়। চোখে জল ঝরে। আর এটাই ভালোবাসা।

ভালোবাসা নামক অনুভবকে কেন্দ্র করে কত রাজা সিংহাসন ছেড়েছেন, কত যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে দেশে দেশে। বর্তমানে এই অনুভূতি কি আমাদের কমে যাচ্ছে?  ভালোবাসা শব্দটি কালো অক্ষরে লেখা গেলেও একে কিন্তু ধরা যায় না হাতের মুঠোয়। কিংবা যত্ন করে ছোঁয়া যায় না। তবে অনুভবের সাগরে ডুব দেওয়া যায় নিশ্চিন্তে। জীবনপাত্রে পান করা যায় চুমুকে চুমুকে। কিন্তু এই অমৃত সুধায় কি ভেজাল মিশেছে বর্তমানের পৃথিবীতে?

চারিদিকে প্রতিদিনের অসংখ্য ঘটনা  মিডিয়া বা পরিচিতের মাধ্যমে যা সামনে আসছে তাতে তো তাই মনে হয়। জান, জানু, জানপাখি ভালোবাসার ডালে বসতে না বসতেই উড়াল দিচ্ছে নতুন ডালের খোঁজে। অথবা চকচকে ডালের লোভে  দ্রুত  উড়ে যাচ্ছে। আমি বলছি নারী-পুরুষের প্রেম বা ভালোবাসার কথা। আগে মনে করতাম সর্ম্পকে জড়ানো যতটা কঠিন তার  চেয়ে কঠিন সর্ম্পক ভাঙা। কিন্তু এখন একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়ে জুটি বদলে যাওয়ার দৃশ্য। খোঁজ নিলে জানতে পারবেন বলবে, আমাদের ব্রেকআপ হয়েছে। অনেকে হয়তো ভাববেন এটাতো নায়ক-নায়িকারা করে। অথবা স্মার্ট মানুষের ব্যাপার। নাহ। আসলে তা নয়। গুলশান, বনানী থেকে কড়াইল বস্তি পর্যন্ত এই ভাঙাগড়ার খেলা। কলেজ পড়ুয়ারা এটাকে টাইম পাস বলে উল্লেখ করছে। অনেক ছেলে-মেয়েকে প্রশ্ন করে আমি এমন উত্তর পেয়েছি। এতো গেল অল্পবয়সীদের টাইম পাস। পরিণত বয়সের নারী-পুরুষ একটা সর্ম্পক শেষ হতে না হতেই আরেকটা সর্ম্পকে জড়াচ্ছেন। অনেকে আবার ফতোয়া দেন হতাশা ও একাকিত্ব কাটাতে এমন করছেন। নতুন সঙ্গী খুঁজে নিচ্ছেন। অনেকে আবার বহু সর্ম্পকে জড়াতে পারাটাকে আধুনিকতা হিসেবে দেখেন এবং এটা তার কারিশমা হিসেবেও ভাবেন। তাহলে যে ভালোবাসা নিয়ে এতো গান, কবিতা তার ঠাঁই কি জাদুঘরে হবে?  না কি অর্থ বদলাতে হবে ভালোবাসা নামক বেকুব শব্দটির। আসুন দেখি ভালোবাসা নামক ব্যাপক প্রভাবক শব্দটিকে আমরা বা সমাজ এমনভাবে ব্যবহার করছি কেন?

এখনতো ঘটা করে ভালোবাসা দিবসও পালিত হয় । লাল গোলাপের ভীড়ে হারিয়ে যায় সাধারণ্যের মুখ। তব্ওু কেন ভালোবাসা দীর্ঘায়িত হচ্ছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ভালোবাসার ক্ষেত্রে ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তত্ত্ব কাজ করে। সংযুক্তি এক ধরনের বন্ধন। যার কারণে যে কোনো ভালোবাসার সর্ম্পক দীর্ঘায়িত করতে পারে।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আমরা প্রকৃত শিক্ষা লাভ করছি না। যদিও উচ্চতর ডিগ্রিধারী মানুষের ছড়াছড়ি। ফলে মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে না। প্রতিটি সমাজে, প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি বিদ্যমান। আর সেটা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চর্চা করে ধারণ করতে হয়। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানুষ খুব দ্রুতই অন্য সংস্কৃতির ওপর ঝুঁকে পড়ে। ফলে সেই সংস্কৃতিকে অনুসরণ করতে যেয়ে এমন কিছু আচরণ করছে যা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না এবং সমাজ তা গ্রহণ কওে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বহু ক্ষেত্রে প্রেমের নামে বিভিন্ন জায়গায় অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ে শারীরিকভাবে মিলিত হচ্ছে। অনেক সময় এটাকে তারা ফান হিসেবে নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সমস্যা তৈরি হলে পুরুষটি তার দায়িত্ব নিতে চাইছে না বা নিচ্ছে না। তখন মেয়েটি পড়ছে অকুলে। এই সমাজ বিবাহবর্হিভূত সর্ম্পক মেনে নেয় না। কত মেয়ে যে এভাবে বিপন্ন হচ্ছে তার কয়টায় বা খবরে জায়গা করে নেয়? জায়গা করে নিলেও বিপদ। পৃথিবীটাই তার কাছে দোজখে পরিণত হবে। সমস্ত পরিবার অসহনীয় জীবন-যাপন করবে। আরেকটা বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য। এই একবিংশ শতাব্দীতে সবকিছু হাতের মুঠোয়। যোগাযোগ মাধ্যম যেমন আমাদের জীবন অনেক সহজ করেছে তেমনি কঠিন করে তুলেছে। মুঠোফোনের অবদানে সর্ম্পক গড়া ভাঙা এখন মাছ-ভাত। খুব সহজেই যেমন সংযুক্তি ঘটছে তেমনি বিযুক্তিও ঘটছে। ব্লক করে দিলেই হলো। একই সঙ্গে একাধিক সর্ম্পকে ভালোবাসার খেলা খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থটাই বড় করে দেখছে যে কোনো এক পক্ষ । নারী অথবা পুরুষ। ফলে প্রতারিত হচ্ছে কেউ না কেউ। আবার প্রেমের নামে জৈবিক চাহিদা মেটানো বা টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যদি খুব ভালোভাবে খেয়াল করি তাহলে দেখবো শরীরকেন্দ্রিক ভালোবাসা বা প্রেমের সর্ম্পক দীর্ঘায়িত হয় খুব কম। সর্ম্পকের ক্ষেত্রে, ভালোবাসা, পারস্পরিক বন্ধুত্ব, দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা এবং  নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্য মানসিক সংযুক্তি ভালোবাসাকে মজবুত ও দীর্ঘায়িত করে।

মানুষসহ অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে জন্মের পর পিতা-মাতার ওপর দীর্ঘকাল নির্ভর করতে হয়। এই সময় ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাহলে হয়তো পৃথিবী জীবশুন্য হয়ে পড়তো। 

ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হয় কিন্তু প্রেম নয়। দূরে থেকেও ভালোবাসা যায় কিন্তু দূর থেকে প্রেম টিকিয়ে রাখা যায় না। আসলে ভালোবাসা শুধু চার দেয়ালের মাঝে কোনো সর্ম্পকের নাম নয়। আকাশ, বাতাস, ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু,  সেখানেও ভালোবাসা প্রকাশিত। কঠিনে, কোমলে এর ব্যাপ্তি। বিশ্বসংসারে যা কিছু আছে তার মাঝে ভালোবাসা বহমান। তাই ভালোবাসার মতো সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক গুনকে কেবল নারী পুরুষের সর্ম্পকের মাঝে দৈহিক প্রয়োজনীয়তার মানদণ্ডে বিচার করলে অন্যায় করা হবে, ছোট করা হবে। ভালোবাসা দিয়ে যারা মানবতার জয়গান গেয়েছেন তাদের ছোট করা হবে। ভালোবাসা আবেগীয় অনুভূতির নাম।
আমরা ভালোবাসা এবং ভালোলাগা শব্দদুটিকে এক অর্থে গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু দুটি শব্দের অর্থ এক নয়। ভালোলাগা হচ্ছে একধরনের মোহ। দু’দিনেই তার অবসান ঘটতে পারে। ভালোবাসা মোহ নয়। তাই এর স্থায়িত্ব বেশি। জাগতিক বিভিন্ন কারণে তা অনেক সময় ভেঙে যেতে  পারে তবুও ভালোবাসাই টিকে থাকে অনাদিকাল। আমি তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটির মধ্যে যতটা দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা লুকিয়ে থাকে ও ‘লাভ ইউ’ এর মধ্যে তা থাকে না। অভিধানে আক্ষরিক অর্থে খুঁজতে গেলে আমার এই কথার হয়তো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্ত ভালোবাসার সংজ্ঞা বলতে আমি এরকমই বুঝি।

আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে শুধু তোমার রুপটাকে ভালোবাসি তা নয়। আমি তোমার ভালো মন্দ সবটুকু নিয়েই ভালোবাসি। সর্ম্পকভেদে তাই ভালোবাসা রঙ বদলায়। বাবা-মা, সন্তান, ভাই-বোন সব ভালোবাসাতেই সমস্ত ক্ষেত্রেই মানুষটা যেমনই হোক না কেন ভালোবাসা থেকেই যায়।শরীরের আধার ভালোবাসা কিন্তু ভালোবাসার আধার শরীর নয়। অর্থাৎ শরীর ভালোবাসাকে আশ্রয় করে বাঁচে কিন্তু শরীরকে আশ্রয় করে ভালোবাসা বাঁচতে পাওে না।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, শারীরিক চাহিদা মেটানোর নাম যদি ভালোবাসা হতো তাহলে পতিতালয়গুলি ভালোবাসার কেন্দ্র হতো। পতিতাদের প্রেমিকা বলে বুকে টেনে নিতো। কিন্তু তা হয় না।কবি গুরুর লাইন দিয়ে শুরু করেছিলাম। গুরু অনেকবার প্রেমে পড়েছেন। কাদম্বরী বৌঠান রবি ঠাকুরের অন্তরআত্মা জুড়ে ছিল কিন্তু সেখানে শরীরের সন্ধান পাওয়া যায় না। কবি ছিলেন বন্ধু, সখা, খেলার সাথী, মানসিক সঙ্গী। ভালোবাসার মানুষকে কবি তাঁর সৃষ্টি উৎসর্গ করেছেন। পরবর্তীকালে বিবাহিত কবি সরে গেছেন দূরে। আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে কবির ভালোবাসা। একে আমরা কি বলবো?  

তাই কবিও খুঁজে গেছেন ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়’। প্রশান্তিময় এক অনুভবের নাম ভালোবাসা যেখানে ডুব দিয়ে নিশ্চিন্ত দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। জায়া, জননী, কন্যায় ভালোবাসা রুপ বদলায়। রুপ বদলায় প্রকৃতি ভালোবাসায়। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই ভালোবাসা নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়, আঁকড়ে ধরে অদৃশ্য শক্তি দিয়ে। যা খোলার সাধ্য জগতের কোনো সৃষ্টির থাকে না। অমোঘ টানে ছুটে আসে সবকিছু পরস্পরের দিকে। ভালোবাসাই তাড়িত করে সকল জীবনকে। ডুবে যেতে চায় নির্ভরতার আশ্রয়ে। আর সেখানেই পরম মমতায় ঘরবাঁধে ভালোবাসা এবং ভালোবাসা। ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’।


লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ
গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ

 


আরও পড়ুন