নূর হাকিম দ্যুতিময় এক বিচারপতি

news paper

শামীম আহমদ

প্রকাশিত: ৩১-৫-২০২৩ দুপুর ১২:৩৭

32Views

যুক্তির সাহায্যে সত্যাসত্য ন্যায়-অন্যায় ভালমন্দ ইত্যাদি নির্ণয়, বিবেচনা করে মানুষ সমাজে মানুষ বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। আইন আদালতে যে বিচার কার্য চর্চা হয় তা কেবল উকিলদের মাধ্যমে সম্পাদন হয়। এর বাইরে আছে বিশাল এক বিচার কার্যের সীমা। সেই সীমায় প্রাথমিক বিচারক মানুষের আত্মা। আমরা মানুষের বিবেক বিবেচনার মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে বিচার কার্যের চর্চা দেখি। তাইতো আলবার্ট আইনস্টাইন বলছেন "নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে কিছুই করা উচিত না, যদি দাবিটা রাজ্যের হয় তবেও না।"

মানুষের আত্মা পরিশুদ্ধ হয় তার বিবেক বিকাশের মাধ্যমে। যখন একজন মানুষের নামের মধ্যে লুকিয়ে তার কর্মের প্রকাশ, তখন ধীরে ধীরে বিকশিত হতে শুরু করে সেই নামটি। নূর শব্দের অর্থ আলো বা জ্যোতি কিংবা দ্যুতি, অন্য দিকে হাকিম শব্দের অর্থ বিচারক। পূর্ন অর্থ পাওয়া যায় দ্যুতিময় বিচারক। তাই আজ একজন দ্যুতিময় বিচারপতির ন্যায় ও সততার গল্প অবতারণা করার চেষ্টা করছি। দ্যুতিময় এই বিচারপতির নাম নূর হাকিম। তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক সকালের সময়ের প্রকাশক ও সম্পাদক।

২০১৬ সাল থেকে দ্যুতিময় এই বিচারপতি নূর হাকিমের আদর্শের প্রতি আমি মননিবেশ করি। ওই বছর বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক মোস্তাক হোসেন নূর হাকিমের সাথে আমাকে আলাপ করিয়ে দেন। মোস্তাক হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের সৎ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, যিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্ব পালন করছেন। মোস্তাক হোসেন যেমন ছিলেন মহান এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী তেমনি নূর হাকিম এক মহান আত্মার অধিকারী। আসলে মানুষের মনুষ্যত্ব বিপুল মৃত্যুর স্তুপের মধ্যে থেকেও সম্পূর্ণ মরতে চায় না। তেমনি নূর হাকিমের মনুষ্যত্ব বিপুল মৃত্যুর স্তুপের মধ্যেও চিরকাল অমরত্ব লাভ করবে।

মানুষের আলো জ্বালায় তার আত্মা, সুন্দর আদর্শ, ন্যায়পরায়নতা, ত্যাগ ও শিষ্টাচার মানুষের আত্মাকে আলোকিত করে। নূর হাকিমের সুন্দর আদর্শ, ন্যায়পরায়নতা, ত্যাগ ও শিষ্টাচার আমাকে মূর্ছিত করে। কিছু দিন আগে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে স্বরচিত কবিতা পড়ে শুনিয়েছেন। তখন মনে হলো নূর হাকিম একজন প্রসিদ্ধ কবি, কবিতা শেষে তিনি আমাকে স্বরচিত গান গেয়ে শুনিয়েছেন। তখন বিস্মিত হয়ে ভাবলাম নূর হাকিম একজন গায়ক, গান শেষ তিনি বর্ণনা করলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনকর্ম নিয়ে একটি চলচিত্রের কথা। এরপর আমি নূর হাকিমের মধ্যে দেখতে পেলাম একজন অভিনেতাকে, যখন জানলাম বঙ্গবন্ধুর ওপরে তিনি নিজে আরো বহু গান লিখছেন তাতে মনে হলো তিনি একজন গীতিকার। আবার সেই গান তিনি নিজেই মিউজিক করবেন। এমনকি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালা করা ছাড়াও, তার নির্বাচনী আসন চুয়াডাঙ্গা থেকে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন। রাজনৈতিক সামাজিক এবং সাংগঠনিক নেতৃত্ব ছাড়াও নানান গুনের চিহ্ন তার ভেতরে দৃশ্যমান।

নূর হাকিম একজন সত্যিকারের মনুষ্যত্বের নিদর্শন। গতকাল সেক্রেটারিয়েটে মধ্যাহ্নভোজকালে এক সাংবাদিক নূর হাকিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন "আপনার চেহারা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে" এই মন্তব্যের উত্তরে নুর হাকিম বললেন মৃত্যুর আগে চেহারা সুন্দর হয়! তখন মনে হলো মৃত্যুর কথা স্বরণ রেখেই যে মানুষ দুনিয়ায় বিচরণ করে মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সে অমরত্ব লাভ করে। আমি বলি নূর হাকিমের সত্য এবং সৎ হৃদয় তার চেহারায় পরিস্ফুটিত। তার স্বচ্ছ হৃদয় এবং তার স্বচ্ছ বিবেক বহু অর্থের চেয়েও দামি। মানুষের বিবেক হলো আত্মার সেই আয়না যা মানুষের জীবনের ভুলগুলো পূর্ণরুপে দেখায়। বিবেক হলো মানুষের আত্মার ধ্বনি যা তাকে সতর্ক করে যে, হয়ত কেউ দেখছে। তাই নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে কিছুই করা উচিত না, যদি দাবিটা রাজ্যের হয় তবেও না।

আমার স্মৃতিপটে নূর হাকিম চির অমর থাকবেন। লিথোগ্রাফি প্রযুক্তিতে আমি তার নাম লিখলে চুরি হতে পারে। তাম্রশাসন খোদিত নামও ক্ষনস্থায়ী। স্মৃতি স্থায়ী করতে দরকার মানুষের হৃদয়পট। হৃদয়পটে স্থায়ী হয় মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে। কর্মের মাধ্যমেই অমর হয় স্মৃতি। যা চিরস্মরণীয়। সেইজন্যে আমরা বুদ্ধি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে, কর্ম দিয়ে কেবলই সমস্তকে খুঁজছি, কেবলই সমস্তের সঙ্গে যুক্ত হতে চাচ্ছি, নইলে যে নিজেকে পাই না। আত্মাকে সর্বত্র উপলব্ধি করবার ইচ্ছে আত্মার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। সত্যকে সর্বত্র দেখলেই সত্যমূর্তি প্রকাশ পায় এবং সেই মূর্তিই আমাদের আনন্দ দান করে। নূর হাকিমের পরিশুদ্ধ আত্মা সর্বত্র উপলব্ধি হয় তার কর্মের মধ্যদিয়ে। এটাই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়। এ পরিচয় চিরকালের। 
   
মাথা-তোলা মানুষের জন্মটাই বড়ো গর্ব। মাথা তুলে বীরদর্পে শির উচ্চ করে নূর হাকিমের বেঁচে থাকা দ্বারাই তার শ্রেষ্ঠতার পরিচয়। এই ব্যস্ততার মধ্যেও মানুষের অনেক দ্বায়িত্ব থাকবে। তাকে বলব আদর্শের দায়িত্ব, মনুষ্যত্বের দায়িত্ব। সেই দ্বায়িত্ব নিয়েই জন্মিয়াছেন নূর হাকিম। দেশ ও মানুষের কল্যাণে সেই দ্বায়িত্বটাই তিনি পালন করে চলছেন। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সত্য মানুষের সম্বল, বিশ্বাস মানুষের ঐশ্বর্য্য। ঐশ্বর্য্যের চরম লক্ষ্য অভাব দূর করা নয়, মহিমা উপলব্ধি করানো। মানুষের আনন্দ মহিমায়। যে-মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মধ্যে আপনার আত্মাকে জানে, সেই জানে সত্যকে। নূর হাকিমের হৃদয় সত্যের আলোয় আলোকিত। এই সত্যের আলো তার জীবন সত্তা। দেশে দেশে কালে কালে মানুষ তার সাধনা দিয়ে এক অখন্ড মানবসত্তা গড়ে তোলে। সেই সত্তা তাকে আপন আত্মা অর্থাৎ আত্মস্বরূপের উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়। সকল মানুষের মিলিত সাধনাতেই অন্তর্নিহিত সত্যের সন্ধান পাই আমরা। তা থেকে মানবমূল্যবোধ তৈরি হয়ে সভ্যতার ভিত্তি পত্তন করে। সুন্দর স্বতন্ত্র ব্যক্তি মানুষই সমন্বিতভাবে সুন্দর মানবসত্তা গড়ে তোলে। সেই পূর্ণের অনুভব ব্যক্তি মানুষের উপলব্ধিতে থাকে। তাই মানুষ জানতে পারে সে ব্যক্তিমাত্র নয়, বিশ্বমানবের অন্তর্গত সত্তা।

শিল্পসাধনার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান আর কর্মের সাধনা মানুষের জগৎকে ক্রমপ্রসারিত করে। সকল সাধনার ফসল মানবসম্পদ হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করে। ব্যক্তিসত্তাকে যদি বলি প্রদীপ, তো আত্মা হচ্ছে তার শিখা। অন্তর-সম্পদই মানুষকে মহৎ করে। নূর হাকিমের অন্তর সম্পদ তাকে সফল করছে সফল ব্যক্তিরা অহংকারী হয় না। জীবনের জন্য ধনসম্পদ বা বিত্তের প্রয়ােজন আছে। কিন্তু বিত্ত মনুষ্যত্বের মাপকাঠি নয়। মহৎ চিত্তের অধিকারী মানুষ নিজের বিবেক দিয়ে ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় উপলব্ধি করে। তারা বিত্তশালী হয়ে থাকলেও প্রাচুর্যের গর্ব করেন না। মনুষ্যত্বের আভিজাত্যের কাছে ধনের আভিজাত্য ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। কিন্তু জগতে এমন লােকও আছে, বিত্তের অন্ধ মােহ যাদের আপন খেয়ালের তরীতে ভাসায়। নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকতে শেখায়। কিন্তু চিত্ত এর ব্যতিক্রম। চিত্তের বলেই মানুষ মানুষকে ভালােবাসে। যে মানুষ অন্য দেবতাকে উপাসনা করে সেই “দেবতা অন্য আর আমি অন্য’ এমন কথা ভাবে, সে তো দেবতাদের পশুর মতোই। অর্থাৎ, সেই দেবতার কল্পনা মানুষকে আপনার বাইরে বন্দী করে রাখে; তখন মানুষ আপন দেবতার দ্বারাই আপন আত্মা হতে নির্বাসিত, অপমানিত। বাউল শাস্ত্রে থেকে জেনেছি- আপন দেবতাকে জানে আপনার মধ্যেই, তাকে বলে মনের মানুষ। “মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ।”  
   
ধন থাকলেই প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মানুষ যার মন উদার। মানব জীবনে অর্থ-সম্পদের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ অর্থ-সম্পদ যদি মানব কল্যাণে ব্যয়িত না হয়, তবে এর কোনাে মূল্য নেই। সংকীর্ণমনা ব্যক্তিরা মহা সম্পদশালী হলেও স্মরণীয় বা বরণীয় হতে পারে না। আর্তের সেবা, দুঃখীর দুঃখ মােচন তথা মানব কল্যাণে তাদের অর্থ ব্যয় হয় না বলে সমাজে তাদের সমাদর ক্ষণস্থায়ী।  মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই এ পৃথিবী থেকে তাদের নাম চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। নিজের লােকেরাও তাদের নাম স্মরণ করে না। পক্ষান্তরে, মানুষের মন এমন এক বস্তু যা মানুষকে অতি উচ্চাসনে নিয়ে যেতে পারে। যে হৃদয় মানব দরদি ও মানব হিতৈষী সেই হৃদয়াধিকারীকে দেখলে মানুষের মাথা আপনিই নত হয়ে আসে এবং তাদের অন্তর অপূর্ব ভক্তিরসে সিক্ত হয়। বর্তমান জগতে মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দেখা যায়, তা অতি কৃত্রিম। তাতে থাকে না কোনো আন্তরিকতা, থাকে শুধু কপটতা আর স্বার্থপরতা। এ ভালোবাসা শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বর্তমানে এ জগতের রথ চলছে মিথ্যা ও ছল নামক ইন্ধনের দ্বারা। এ রথে যারা চলছে, তাদের প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। প্রকৃত মানুষ না হতে পারলে এ উন্নতির কোনো মূল্য নেই।

আমাদের হারিয়ে যাওয়া এ মনুষ্যত্ববোধ ও চারিত্রিক গুণাবলি ফিরিয়ে আনতে চাই পারস্পরিক সম্প্রীতি। মনুষ্যত্বহীন মানব পানিবিহীন সাগরের মতো। পানিহীন সাগরের যেমন পরিচয় পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি মনুষ্যত্বহীন মানুষেরও কোনো পরিচয় নেই। এ জগতের বাহ্যিক রূপ অতি সুন্দর; কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ রূপ বড়ই জটিল। মানুষও জগতের মতোই। এই জটিল সময়ে নূর হাকিমের মনুষ্যত্ব আমাকে বিমোহিত করে। বিচারের আদালতের উপরেরও এক আদালত আছে যা সব আদালতকে ছাড়িয়ে যায়, তা হলো বিবেকের আদালত। নূর হাকিম এমন এক আদালতের প্রধান বিচারপতি। যেখানে আছে মানুষের সত্যিকারের মনুষ্যত্ব। বিশ্ব মানবিকতার এই দুঃসময়ে নূর হাকিমের মনুষ্যত্ব সমস্ত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক সূর্যের আলোর ন্যায়।


আরও পড়ুন