মুমূর্ষ রোগীর জন্য জীবনদায়ী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে আইসিইউ

news paper

নিশাত শাহরিয়ার

প্রকাশিত: ২২-৫-২০২৩ দুপুর ৩:৪৩

39Views

ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান আকাশ

ব্যাথা ও আইসইিউ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ |

সহযোগী অধ্যাপক ও  বিভাগীয় প্রধান।

শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, উত্তরা, ঢাকা। 


ICU এর ধারণাটি প্রথম বিকশিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময়। ঐ সময় মহীয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল গুরুতরভাবে আহত রোগীদের ICU কম আহত রোগীদরে থেকে আলাদা করে সেবা প্রদানরে ব্যবস্থা করেছিলেন  সহজ এই পদক্ষেপের ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুরহার ৪০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল । ১৯৫৩ সালে বিশ্বের প্রথম নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট গঠিত হয়েছিল ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। ডেনমার্কে পোলিও প্রাদুর্ভাবের মহামারী হওয়ার সময় এটি তৈরি হয়েছিল। নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের  পথ প্রদর্শক ছিলেন ডেনিশ অ্যানেস্থেটিস্ট বিজর্ন ইবসেন। ভারতের দিল্লিতে আরউইন হাসপাতালে প্রথম ICU প্রতিষ্ঠা করেছিলেন  প্রফেসর এন.পি.সিং। আইসিইউ বা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটরে গুরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকে দৈনিক  সকালরে সময়রে প্রতবিদেক নিশাদ সাহরিয়ার সাথে কথা বলেছেন  শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (আইসিইউ ), ব্যাথা ওআইসিইউ   মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান  আকাশ। 

সকালের সময়: আইসিইউ বা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বলতে কি বোঝায় ?

ডা. মোস্তাফিজুর  রহমান আকাশ: আইসিইউ হল বিশেষায়িত একটি ইউনিট। অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ের যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে তার  মধ্যে একটি হলো আইসিইউ। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট ( ICU) বলতে এমন একটি স্থানকে বোঝায় যেখানে রোগীদের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। গুরুতর অসুস্থ এবং আহত রোগীদের গুরুতর যত্ন এবং সার্বিক দেখভালে আইসিইউ এর গুরত্ব অপরিসীম। মোদ্দাকথা, আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র হল হাসপাতালের একটি বিশেষায়িত বিভাগ। এখানে জটিল রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। আইসিইউ নামের এই জীবনদায়ী ব্যবস্থা সব রকমভাবেই রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করে|

সকালের সময়: কোন কোন ক্ষেত্রে আইসিইউ ব্যবহার করা হয় ?

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আকাশ: আমাদের শরীরে অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করে যেমন- কিডনি, লিভার, হার্ট, ফুসফুস, মস্তিষ্ক। কোনো কারণে যদি এই অঙ্গগুলো বিকল হয়ে যায় কিংবা কাজ করতে না পারে, তখন বিশেষ যন্ত্রের সহযোগিতায় অঙ্গগুলোকে সচল করা হয়। তবে অঙ্গ সচল রাখার জন্য রোগীদের সাধারণ ওয়ার্ডে রাখা সম্ভব নয়। তখন তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেয়া হয়। রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক হলে আইসিউতে সবরকমের সাপোর্ট দিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রোগীর যাবতীয় শারীরিক সঙ্কটের মোকাবেলার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা থাকে। ক্রিটিক্যাল কেয়ারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ছাড়াও প্রত্যেক প্যারামেডিক্যাল স্টাফকেও বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সকলেই রোগীর ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখেন। দরকার হলেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। অনবরত হৃৎপিণ্ডের গতিবিধি, শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ, শ্বাস-প্রশ্বাসের অবস্থা, সবকিছু অনবরত পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি কোনও রকম সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গেই সব রকমের সাপোর্ট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় বিশেষায়িত এই ইউনিটে। এছাড়া, নিউমোনিয়া, সিওপিডি, অ্যাজমার কারনে সাংঘাতিক শ্বাসকষ্ট, দুর্ঘটনায় চোট পাওয়া, ভয়ানক ভাবে পুড়ে যাওয়া, বিষাক্ত সাপের কামড়, ওষুধের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ওষুধে অ্যালার্জির জন্য শ্বাসনালী ফুলে গিয়ে শ্বাসকষ্ট, গুরুতর অসুখের কারণে শ্বাসকষ্ট, শরীরের ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বিঘ্নিতসহ কোনও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কাজ সাময়িক ভাবে বিপর্যস্ত হলে রোগীকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়। অনেক সময় রোগীর অবস্থা খুব ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও হার্টের বাইপাস সার্জারি, অরগ্যান ট্র্যান্সপ্ল্যান্টসহ যে কোনও মেজর সার্জারির পর চটজলদি বিপদ মোকাবিলার জন্যে রোগীকে আইসিইউতে রাখা হয়। মোটকথা, রোগীর অবস্থা যদি ক্রমাগত অবনতি হতে থাকে তাহলে সরাসরি আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে অনেক হাসপাতালেই আইসিইউ সুবিধা রয়েছে।

সকালের সময়: আইসিইউএর মধ্যে প্রকারভেদ আছে কিনা ? 

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আকাশ: সঙ্কটাপন্ন রোগীদের বিপদমুক্ত করতে বিশেষ ব্যবস্থাযুক্ত ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের নানান ভাগ রয়েছে। যেমন- সদ্যোজাতদের জন্য ক্রিটিক্যাল কেয়ার ‘নিকু’ বা ‘এনআইসিইউ’। সদ্য জন্মানো  বাচ্চাদের অল্প ওজন থেকে শুরু করে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে শিশুর জন্মানোসহ নানান শারীরিক ত্রুটি, শ্বাসকষ্ট, জন্ডিসসহ নানা সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য  ‘পিকু’ বা ‘পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার’, ‘আইটিইউ’ বা ‘ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিট’, ‘সিসিইউ’ বা ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট’, ‘আইসিসিইউ’ বা‘ ইনটেনসিভ করোনারি কেয়ার ইউনিট’ চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এছাড়াও রয়ছেে হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট সার্জারি রোগীদের জন্য করোনারি কেয়ার এবং কার্ডিওথোরাসিক ইউনিট। অস্ত্রোপচার রোগীদের জন্য সার্জিক্যাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। মেডিকেল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। ট্রান্সপ্লান্ট আইসিইউ যেখানে ট্রান্সপ্লান্ট পরবর্তী রোগীদের রাখা হয়। যেমন- লিভার, কিডনি, অগ্ন্যাশয়, হার্ট, ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা হয় যসেব  রোগীদের। 

সকালের সময়:   ICU বিভাগে চিকিৎসা সরঞ্জাম হিসেবে কি কি ব্যবস্থা থাকে ? 

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আকাশ: যখন একজন রোগীকে আইসিইউতে নেয়া হয় তখন রোগীর অবস্থা মূল্যায়নের জন্য ডাক্তার এবং নার্সরা নানা রকম পরীক্ষা করে থাকেন। রোগীর রোগ নির্ণয়ের পর পরিবারের সদস্যদের যতদ্রুত সম্ভব জানানো হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।   ICU বিভাগে চিকিৎসা সরঞ্জাম হিসেবে বেশকিছু ব্যবস্থা থাকে যার মাধ্যমে একজন রোগীকে পরিস্থিতি অনুযায়ী সব রকম সেবা দেয়া হয়।   ICU বিভাগে বেশকিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকে। যেমন- ১. ইসিজি বক্স ২. যান্ত্রিক ভেন্টিলেটর ৩. খাওয়ানোর টিউব ৪. পালস অক্সিমিটার ৫. ডায়ালাইসিস মেশিন ৬. সংমিশ্রণকারী পাম্প ৭. রোগীর মনিটর ৮. ফিড পাম্প ৯. ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) ১০. পিচকারি পাম্প ১১. সাকশন টিউব ১২. এনসেথশেয়িা মেশিন ১৩. বাহ্যিক পেসমেকার ১৪. রক্ত গরম করার যন্ত্র ১৫. ডিফিব্রিলেটর ১৬. ফ্ল্যাশ অটোক্লেভ ১৭. অক্সিজেন প্রবাহ মিটার ১৮. সাকশন ইউনিট ১৯. বেডপ্যান ওয়াশার ২০. মেডিকেল আসবাবপত্র ২১. স্টেথোস্কোপ ২২. নেবুলাইজার ২৩. ল্যারিঙ্গোস্কোপসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম। 

সকালের সময়: মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে আইসিইউ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে অনকে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্বে এ বিষয়ে কি বলবেন ? 

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আকাশ: দেশের সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে আইসিইউএর আসন সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এই সীমিত আসন সংখ্যার কারণে রোগীর স্বজনরা যখন রোগীদের জন্য আসন বরাদ্দ করতে পারেন না, তখন তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তখনই সুযোগ বুঝে সক্রিয় হয়ে ওঠে আইসিইউ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট। তবে সময় যতই যাচ্ছে মানুষ ততই সচেতন হচ্ছে। আবার প্রশাসনও এসব ব্যাপারে কঠোর হচ্ছে। এছাড়া সার্বক্ষনিক মিডিয়ার নজরদারী তো রয়েছেই। তাই বলা যায়, ধীরে ধীরে এসব ঘটনা কমে আসছে পাশাপাশি আইসিইউর বেড সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। তবে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা রোগী এবং স্বজনদের জন্য খুবই দু:খজনক। 

সকালের সময়: দৈনিক সকালের সময়রে পক্ষ  থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। 

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আকাশ: আপনাকেও ধন্যবাদ। 

 

 

 

 


আরও পড়ুন