দক্ষিণ এশিয়ার নতুন সিঙ্গাপুর মাতারবাড়ি

news paper

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২৯-৪-২০২৩ দুপুর ৪:২৬

16Views

১৯৬২ সালে জাপানের কাশিমা বন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়। তখন সেখানে ছিল ধানক্ষেত। আজ তা হয়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বিখ্যাত সেই কাশিমা বন্দরের আদলে কুতুবদিয়ার মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। দ্রুত এগিয়ে চলেছে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি মাতারবাড়ী প্রকল্প সম্পর্কে যথেষ্ট আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এটা অনেক বড় প্রকল্প হতে যাচ্ছে। বাস্তবায়নের পর মাতারবাড়ী হবে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি আসিয়ান অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে।দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোর পণ্য নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাগামী জাহাজকে সিঙ্গাপুর-শ্রীলংকার কলম্বো-মালয়েশিয়ার তাঞ্জুমপালাপাস এবং কেলাংকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। আগামীতে সমুদ্রগামী জাহাজগুলোর জন্য মাতারবাড়ি বন্দরই ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে গড়ে উঠবে। এ লক্ষ্যে অনেকটা সিঙ্গাপুর বন্দরের আদলেই এটিকে গড়ে তোলা হচ্ছে।
মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজের সুবিধার্থে চীন থেকে আনা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ড্রেজার মেশিন ‘ক্যাসিওপিয়া-ফোর’ সাগরের বুকে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। সাগরের কাদা মাটি অপসারণ করে একেবারে তীরে নীল জলরাশি আনার পেছনে এ মেশিনের বড় ভূমিকা রয়েছে। মাতারবাড়ির টাউনশিপ এলাকাতেই থাকবে মাদার ভ্যাসেলের অবস্থান। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে এখানকার সাগরের গভীরতা বাড়ানোর পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে নতুন চ্যানেল।জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করছে মাতারবাড়ী উন্নয়ন প্রকল্প। দুই ধাপে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের মধ্যে। কাজ শেষ হলে এই বন্দরে ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারবে। সাধারণত ১৪ মিটার গভীরতার জাহাজ যে বন্দরে ভিড়তে পারে, সেটাকেই গভীর সমুদ্রবন্দর বলা হয়। ২০২৫ সালে নতুন এক বাংলাদেশ পাবে বিশ্ব। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বদলে যাবে বাংলাদেশের চেহারা। থার্ড টার্মিনাল, মাতারবাড়ী প্রকল্প, মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন স্থান করে নেবে। তিনি জানান, বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে। তিন শতাধিক জাপানি কম্পানি এখন বাংলাদেশে কাজ করছে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি গড়ে উঠছে বিদ্যুৎ হাব। থাকছে এলএনজি টার্মিনাল। বন্দর, বিদ্যুৎ ও এলএনজি সুবিধা থাকায় এখানে গড়ে উঠবে একটি শিল্প হাব। গড়ে তোলা হবে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিং মলসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও। মাতারবাড়ি বন্দর হলে সেখানে সাড়ে ১৮ মিটার ড্রাফটের (গভীরতা) পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো বন্দরে এ ধরনের মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) ভেড়ার মতো সমুদ্রবন্দর নেই। তাই এ বন্দরটি হয়ে উঠবে আঞ্চলিক হাব। বদলে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি।২০২৬ সালে এ বন্দর চালু করতে পারলে আমাদের সিঙ্গাপুর বা অন্য কোনো হাব পোর্টের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এখান থেকে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে চলে যেতে পারবে। এতে আমাদের রপ্তানি খরচ অনেক কমে যাবে, কারণ সময় অনেক কমে যাবে।
মিয়ানমারের সিতুই, কলকাতার হলদিয়া, ভাইজাক, আন্দামানসহ বঙ্গোপসাগরের এ বেল্টে কোনো বন্দরে ১৬ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে না। এখানে যদি এ বন্দর হয়, এটি এখানকার রিজওনাল হাব হতে পারে।মাতারবাড়িতে বন্দর করতে যে বিনিয়োগ করা হবে তা ৭ থেকে ৮ বছরের মধ্যে ফেরত আসবে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর প্রতি বছর ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা নিট লাভ করে। মাতারবাড়ি বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে ৯ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে। সেটা ৭-৮ বছরের মধ্যে উঠে আসবে। প্রতি বছর এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হবে।এখন বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় কোনো পণ্য যেতে ৪৫ দিন লাগে তবেমাতারবাড়ি থেকে সরাসরি যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৩ দিন। সময় কমলে খরচ কমবে। সবকিছু মিলিয়ে যদি বলি তাহলে মাতারবাড়ি প্রতি বছর আমাদের পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করবে।তখন কলম্বো ও সিঙ্গাপুরের বন্দরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবো আমরা।
বঙ্গোপসাগরের উত্তর বেল্টে যারা আসবেন তাদের অপশন একটাই, মাতারবাড়ি। কারণ আশপাশের কোনো বন্দরে এত বড় জাহাজ হ্যান্ডেল করতে পারে না। ভারত, নেপাল, ভুটানকে এ বন্দরকে ব্যবহার করতে হবে। কলকাতার হলদিয়া বন্দরে মাত্র সাড়ে ৭ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। খরচ যেখানে কম হবে স্বাভাবিকভাবেই সবাই সেখানে যাবে। মাতারবাড়ি বন্দর হলে আমাদের সময় ও ব্যয় কমে যাবে। এটা আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলবে। এখানে লবণ ক্ষেত ছিল। এখানে একটা স্মার্ট নগরী ও স্মার্ট বন্দর হচ্ছে। এখানকার স্মার্টনেস সিঙ্গাপুরকেও ছাড়িয়ে যাবে। সব মিলিয়ে মাতারবাড়ী হয়ে উঠেছে অফুরন্ত সম্ভাবনার এক কেন্দ্র।


আরও পড়ুন